জাতীয়

বন্যা শেষে বেঁচে থাকার সংগ্রামে দুর্গত মানুষেরা

ডেস্ক রিপোর্ট: টমটমচালক মোবারক হোসেনের বাড়িটা মাটির সঙ্গে অনেকটা মিশে গেছে। টিনের চালের নিচে আসবাব, রান্নার সামগ্রী চাপা পড়েছে। সেখান থেকে কিছু জিনিসপত্র উদ্ধারের পাশাপাশি আবার ঘরটাকে মেরামতের চেষ্টা করছেন তিনি।

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ বড়ইয়ায় এমন চিত্র দেখা গেছে। সহায়–সম্বল হারানো মোবারক আপাতত টিন দিয়ে একটি ঘর তৈরি করে স্ত্রী–সন্তানসহ থাকছেন। বেড়া ও টিনের চালার মূল ঘরটিকে কোনোরকমে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন তিনি। মোবারকের মতো আরও অনেক দুর্গত সব হারানোর দুঃখ ভুলে নতুন করে বাঁচার লড়াইয়ে নেমেছেন।

কেউ মাথা গোঁজার জায়গাটা বসবাস উপযোগী করছিলেন, কেউ ঘরে ঢোকার রাস্তা মেরামতে ব্যস্ত, আবার কেউ ডুবে যাওয়া আসবাব রক্ষণাবেক্ষণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার কাউকে কাউকে মরে যাওয়া কৃষিজমিতে নতুন করে আমান চারা রোপণে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।

গত ২০ আগস্ট থেকে ফেনীতে ভয়াবহ এ বন্যা দেখা দেয়। এখানকার বয়োবৃদ্ধরা এমন ভয়াবহ বন্যা আর কখনো দেখননি। আকস্মিক বন্যার শুরুতে প্রশাসন ও স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে কিছুটা হতচকিত ভাব দেখা গেলেও পরে তা সামলে ওঠেন তাঁরা। উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ বিতরণে সরকারি–বেসরকারি লোকজন এবং বিভিন্ন বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে।

২৫ আগস্ট থেকে বন্যার পানি নামতে শুরু করে। তবে পানি নামার চার–পাঁচ দিনেও ক্ষয়ক্ষতির কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি হয়নি। কী পরিমাণ বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে কিংবা ফসলের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যায়নি এখনো। ৫ আগস্টের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতি, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর পানিতে তলিয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে বিলম্ব হচ্ছে।

বন্যাসংক্রান্ত ক্ষতি নিরূপণের সঙ্গে জড়িত জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ফাহমিদা হক প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন দপ্তর তালিকা তৈরি করছে। বিভাগ অনুযায়ী ক্ষতি নিরূপণ চলছে। ঘরবাড়ির ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও শিগগিরই পাওয়া যাবে। তবে ত্রাণ বিতরণ চলছে। গৃহ পুনর্নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে তালিকা হাতে আসার পর সহযোগিতা করা হবে।

এ বন্যায় ফেনীতে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় দেড় লাখ মানুষ। গতকাল শনিবারও ২২ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছিল।

তবে বাড়ি ফিরে অনেকে শূন্য ভিটায় নতুন করে একটু মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করছিলেন। কিন্তু নতুন করে ঘর নির্মাণের সংখ্যাটা একেবারে নগণ্য। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এসব লোক সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের গৃহ পুনর্নির্মাণের সহায়তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

ফুলগাজীর দক্ষিণ শ্রীপুর ভূঁইয়া বাড়ির বাসিন্দা মো. মুর্শেদের বাড়িটাও বন্যায় ভেঙে গেছে। নষ্ট হয়েছে আসবাবসহ বিভিন্ন জিনিস। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ভেঙে যাওয়া বেড়া মেরামতে ব্যস্ত দেখা গেল তাঁকে।

বেসরকারি চাকরিজীবী মুর্শেদ বলেন, ‘ঘর ভঙে গেছে। আমরা এক সপ্তাহ পাশের বাড়ির বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। দুই দিন আগে থেকে ভাঙা ঘরটি কোনোরকমে থাকার উপযোগী করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

ফুলগাজী মুন্সিরহাট এলাকার রেনু আকতারও তাঁর টিনের ঘরটি মেরামতে নিজেই লেগে পড়েন। পানির স্রোতে ঘরের বেড়া ও মাটি সরে গেছে। মাটি ভরাটের কাজ নিজেই করছিলেন।

রেনু বলেন, ‘আমার স্বামী (নাজিম) বিদেশে থাকেন। কাজের লোকজনও পাচ্ছি না। তাই নিজে লেগে পড়ি।’

ফেনী সদর উপজেলার তুলাবাড়িয়া পাড়ায় প্রায় ২০০ বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের বাড়িতে কোমরপানি ছিল। নিখিল চন্দ্র পালসহ কয়েকজনের ঘর একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। নিখিল বলেন, ‘ঘর মেরামতের টাকা আমাদের হাতে নেই। এখন অন্যত্র আছি। জানি না কীভাবে ঠিক করব।’ নিখিল পালের পাশের বাসিন্দা রনি পালকে তাঁর সেমি পাকা ঘরের কাদা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত দেখা গেল।

আবার ফুলগাজীর দক্ষিণ বড়ইয়া এলাকায় দেখা যায়, পানিতে তলিয়ে যাওয়া আমনের জমিতে নতুন করে চারা রোপণ করছেন তিনজন কৃষক।

একই উপজেলার বসন্তপুরে সজল ঘোষের খামারের পাঁচ হাজার মুরগি মারা যায়। গতকাল দুপুরে দেখা যায়, খামারের মেঝে আবার তৈরি করতে ব্যস্ত সজল ও কর্মীরা। সজলের মা সুমিত্রা বলছিলেন, অনেক টাকার মুরগি মারা গেছে। তবু তো তো নতুন করে বাঁচতে হবে।
কুমিল্লায় বন্যার্তদের চোখেমুখে আতঙ্ক

কুমিল্লা সংবাদাতা জানান, ভারী বর্ষণ আর ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ২৩ আগস্ট ফুলেফেঁপে ওঠে গোমতী নদীর পানি। এ নদীর পারে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকা। আশপাশের গ্রামগুলোকে রক্ষা করতে নদীর পাড়ে একটি সড়ক বাঁধ আছে। ২৩ আগস্ট রাতে পানির তোড়ে সেই বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় উপজেলার কয়েক শ গ্রাম। কোনোমতে জীবন নিয়ে যে যার মতো করে আশ্রয় নেয় নিরাপদ স্থানে। এসব গ্রামবাসীর চোখেমুখে এখনো সেই ভয়াল রাতের ছাপ লেগে আছে।

গোমতীর বাঁধ ভাঙনের রাতে স্থানীয় সহস্রাধিক পরিবার নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। অনেকে বাড়িতে ফিরে গেলেও এখনো শতাধিক পরিবার বাঁধে আছে।

গতকাল সরেজমিনে বুড়বুড়িয়া গোমতীর বাঁধে দেখা যায়, কিং বাজেহরা থেকে বুড়বুড়িয়া পর্যন্ত সড়ক বাঁধের ওপর শতাধিক পরিবার ৯ দিন ধরে বসবাস করছে। ত্রিপল টানিয়ে তাঁর নিচেই চলে ঘুম-খাওয়া। কেউ কেউ পাশে গরু–ছাগল বেঁধে রেখেছেন। বাঁধের ওপর দু-একজন নারীকে মাটির চুলা বানিয়ে রান্না করতে দেখা যায়।

নদীর বাঁধ যে স্থানে ভেঙেছে, সেখানে শতাধিক মানুষ। ঘুরে ঘুরে তাঁরা ভাঙা জায়গাটা দেখছেন। বাঁধের অন্তত ৫০০ ফুট অংশ ভেঙেছে এখানে। এখনো পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে। অনেকে এসেছেন নৌকা নিয়ে জায়গাটি ঘুরে দেখতে। কেউ কেউ সেখানে মাছ ধরছিলেন।

বুড়বুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল হালিমের পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। তিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক। সে রাতের কথা মনে করে আঁতকে ওঠেন আবদুল হালিম। বলেন, যখন গোমতীর পানি বেড়েছিল, তখন থেকে ভয়ে অটোরিকশা চালানো বন্ধ করে গোমতীর পাড়ে অবস্থান নেন। বৃহস্পতিবার রাতে যখন গোমতীর পানি বাঁধ ছুঁই ছুঁই করে, সেদিন তিনি পরিবারসহ এই বাঁধে অবস্থান নেন। যখন মাইকে শুনেছেন, নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে, তখন আবদুল হালিম দৌড়ে বাড়ি যান। তিনি বলেন, ‘গাঙ ভাঙছে হুইন্না দৌড় দিয়া ঝি–পুত আর বউয়েরে লইয়া গাঙের পার আইছি। এই ৯ দিন আমরা গাঙের পার আছি। বাইত এহন ফেককাদা। আরও এক সাপ্তাহ লাগব বাইত যাইতে।’

গোমতীর বাঁধে একেকটি ত্রিপলের নিচে একাধিক পরিবার গাদাগাদি করে বসবাস করছে। বুড়বুড়িয়া গ্রামের আয়চান বিবি বলেন, তাঁর পরিবারসহ এক ত্রিপলের নিচে আছেন ১৩ পরিবারের সদস্য। ত্রাণসামগ্রী আর রান্না করা খাবার পাচ্ছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘আমি হাডের (হার্টের) রোগী। আমারে ছেলেরা আমারে লইয়া দৌড়াইয়া লইয়া যায়। আমি তহন কিতাম (বলতে) পারতাম না, কেমনে আইছি গাঙের পার। আমার বয়স ৬০ বছর। এত পানি আমি আর দেখছি না। আমার হাউরিও (শাশুড়ি) দেখছে না।’

বুড়বুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার চোহে হেই রাইতের কথা ভাইস্যা ওডে। গাঙডা যখন ভাইঙা যায়, হেই সময় পানির কী ডাক আইছিল! মনে হইছে দুনিয়াডা ডুবাইয়া লইব।’

সে রাতের কথা মনে করে কেঁদে ওঠেন বাঁধে আশ্রয় নেওয়া রেনু আরা বেগম। তাঁর স্বামী ট্রাকচালকের সহকারী। মাইকে বাঁধ ভাঙার খবরে তিন ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে দৌড়ে বাঁধে আসেন। আসার সময় তাঁর শাড়ির আঁচলে থাকা তিন হাজার টাকা হারিয়ে ফেলেন। তবে তাতে রেনু আরা বেগমের আক্ষেপ নেই। রেনু বলেন, ‘কোনো রহম পুত আর জামাইরে লইয়া জানডা বাঁচাইতে পারছি। আল্লাহ বাঁচাইলে টাকা হইব।’

টানা ৯ দিন বাঁধে থাকার পর বাড়ির মায়ায় ফিরে গিয়েছিলেন মো. সেলিম। তিনি গিয়ে দেখেন, তাঁর ঘরে এখনো কোমরপানি। তিনি বলেন, ‘হেই রাতে পিন্দনে যা আছিল, তা লইয়া কোনো রহম জানডা বাঁচাইছি। আইজ বাইত গেছিলাম। বাইত যাইয়া দেহি, আমার ঘরের ভিত্রে কোমরপানি। আর কয় দিন লাগে পানি কমতে, আল্লাই জানে।’
সুত্র: প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *