কলারোয়া

কলারোয়ায় ধান খেতে পানি দেওয়া নিয়ে ৩ বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর লুটপাট

স্টাফ রিপোর্টার: বোরো চাষে মটরের পানি দেওয়াকে কেন্দ্র করে একই পরিবারের প্রতিবন্ধি নারী ও শিশুসহ ১৬ জনকে টিপিয়ে জখম করা হয়েছে। এ সময় তিনটি পরিবারের বসতবাড়ি ও রান্নাঘর, শোকেস, আলমারি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে দুই লক্ষাধিক নগদ টাকাসহ তিন লক্ষাধিক টাকার মালামাল। গতকাল শুক্রবার দুপুর দুটোর দিকে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কেড়াগাছি ইউনিয়নের গোয়ালচাতর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আহতদের কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

আহতরা হলেন, গোয়ালচাতর গ্রামের সাফাতুল্লাহ সরদারের ছেলে কামরুল ইসলাম, একই গ্রামের কামরুল সরদারের ছেলে হাসানুজ্জামান ওরফে মাহাবুল্লাহ সরদার, গোলাম মোস্তফার ছেলে আব্দুল্লাহ, বরকতুল্লাহ সরদারের ছেলে গোলাম মোস্তফা, গোলাম মোস্তফার চেলে হাফিজা খাতুন, রেজাউলের স্ত্রী আফিয়া খাতুন, শওকত সরদারের মেয়ে লিপি খাতুন, লিয়াকত সরদারের মেয়ে রিমি খাতুন, গোলাম মেস্তফার ছেলে আসাদুজ্জামান, হাসান সরদারের স্ত্রী আলো খাতুন, কামরুল ইসলামের স্ত্রী শাহানারা খাতুন, কামরুল ইসলামের প্রতিবন্ধি মেয়ে সোয়ানা খাতুন, আলো খাতুনের সাত মাসের সন্তান জাকারিয়া হোসেন, আসাদুজ্জামানের স্ত্রী রুমানা খাতুন ও তাদের দেড় বছরের মেয়ে আরোহী জান্নাত এবং দুই মাসের মেয়ে সাফা জান্নাত।

অভিযোগ, হামলাকারিদের সহিংসতার এতটাই ভয়াবহতা ছিল যে, হাসপাতালে হুমকি দেওয়ার পর পা ভেঙে যাওয়া দুগ্ধপোষ্য সন্তান নিয়ে দুই নারীসহ আটজন ভর্তি না হয়ে জরুরী বিভাগ থেকে প্লাস্তার করে ও প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। দিতে পারেননি থানায় অভিযোগ। উপরন্তু হামলাকারিরাই কাল্পনিক আহত সেজে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নির্যাতিতদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিয়েছে।

সরেজমিনে শনিবার সকালে কলারোয়া উপজেলার কেঁড়াগাছি ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের পাগলা খালের গোয়ালচাতর দক্ষিণপাড়ায় যেয়ে দেখা গেছে আসাদুজ্জামানের বাড়ির টিনের বেড়া, ঘরের মধ্যে আলমারি, শোকেস, চেয়ার, টেবিল, ফ্রিজসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। লোহার রড ও বাঁশের লাঠি দিয়ে ভাংচুর করা হয়েছে ঘরের চাল। জখমী অবস্থায় ডান পায়ে প্লাস্টার করে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন জর্দান থেকে দেড় বছর আগে দেশে ফেরা সাত মাসের সন্তানের জননী আলো খাতুন, কামরুল ইসলামের স্ত্রী শাহানারা খাতুন, আসাদুজ্জামানের স্ত্রী রুমানা খাতুন, প্রতিবন্ধি সোয়ানা খাতুন। তাদের মধ্যে পুলিশ আতঙ্ক বিরাজ করছে।

প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় শওকত হোসেন, আলী হাসান, আরশাদ আলী ও গোলাম হোসেন বলেন, গোলাম মোস্তফা, তার ছেলে আসাদুজ্জামানসহ তাদের কয়েকটি বাড়িতে ঢুকে নারী, পুরুষ ও শিশুদের লোহার রড ও বাঁশের লাঠি দিয়ে ওবায়দুর রহমান, রবিউল, মফিজুলসহ ২০/২৫ জন এমনভাবেই হামলা চালায় যে, অনেকেই হামলাকারিদের ভয়ে গোলাম মোস্তফার খুলে যাওয়া লুঙ্গি পরিয়ে দিতে পারেননি। কয়েকজনকে মারতে মারতে পাগলা খালে ফেলে দিলেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে নারী ও শিশুদের রক্ষা করতে যেয়ে তাদের মেয়ে লিপি, রিমিসহ কয়েকজন জখম হয়েছে ওবায়দুর ও তার সহযোগীদের লাঠির আঘাতে। মাটিতে পড়ে যাওয়ায় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী লিপি খাতুনকে হায়নার মত ছিঁড়ে খাওয়ার চেষ্টা করেছে ওবায়দুরের লোকজন।

গোলাম মেস্তাফার ছেলে আসাদুজ্জামান জানান, পার্শ্ববর্তী ধোপারজেল বিলে তাদের তিন বিঘা জমি রয়েছে। ওই জমিতে তারা বোরো ধান লাগিয়েছেন। ওই বিলে বোরা চাষের সুবিধার্থে মফিজুল ও তারাসহ ১০ জন মিলে বৈদ্যুতিক মটরে সেচের পানির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বাইরের এক ব্যক্তির কাছ থেকে দুই সপ্তাহ আগে লাঙ্গল এনে নিজ জমি চাষ করলেও মফিজুলের কাছ থেকে লাঙ্গল না নেওয়ায় সে ক্ষুব্ধ ছিল। একপর্যায়ে তাদের জমিতে পানি কম দেওয়ায় জমির একাংশের ধান পানির অভাবে শুকিয়ে যায়।

কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন কামরুল সরদার জানান, জমি পরিচর্যার জন্য তিনি কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে শুক্রবার সকাল আটটার দিকে ধোপারজেল বিলে যান। সেখানে যেয়ে তার ধান খেতের একটি অংশ পানির অভাবে শুকিয়ে যেতে দেখেন। পরবর্তীতে তিনি বিষয়টি মফিজুল ও তার ভাই রবিউলের কাছে প্রতিবাদ করেন। একপর্যায়ে বিরোধ চরমে উঠলে তিনি বাড়ি চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন যে তারা নুরানী সরদার হাফিজাখানা ও মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে তাদেরকে মফিজুল, ওবায়দুলসহ তাদের লোকজন মারপিট করবে মর্মে খবর পান। তারা নামাজ পড়তে যাননি। দুপুর দুটোর দিকে মসজিদের বারান্দায় রাখা লোহার রড, বাঁশের লাঠি নিয়ে আজিজ সরদারের ছেলে ওবায়দুর সরদার তার ভাই মোকলছ সরদার, আব্দুর রাজ্জাক সরদারের ছেলে সিরাজুল, শহীদুল, মফিজুল, রবিউল, সিরাজুলের স্ত্রী রুমা, শহীদুলের স্ত্রী ফুলি, আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে শারমিন ও মমতাজ, শহীদুলের ছেলে আজমল, সিরাজুলের চেলে ফয়সালসহ ২০/২৫ জন গোলাম মোস্তফা, তার ছেলে আসাদুজ্জামান, হাসান ও তার (কামরুল) বাড়িতে হামলা চালায়। একপর্যায়ে হামলাকারিরা ওই সব পরিবারের ১৫ জনকে পিটিয়ে জখম করে। ভাঙচুর করে গোলাম মোস্তফা ও আসাদুজ্জামানের বসত ঘর ও রান্না ঘর। আসাদুজ্জামানের আলমারি থেকে বাড়ি তৈরির জন্য রাখা নগদ দুই লাখ টাকা, সোনার গহনাসহ তিন লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুটপাট করে।

হামলাকারিদের আক্রমণ এতটাই বিভৎস্য ছিল যে মারাত্মক জখম হওয়া কয়েকজনকে রক্ষা করতে গেলে প্রতিবেশি ও পথচারিরা আহত হয়েছে। তারাও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। গোলাম মোস্তফাসহ সাতজনকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে যেয়ে হুমকি দেওয়ায় তিন শিশুসহ নয়জনকে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়েছে। হামলাকারিরা জনৈক বিএনপি নেতা সবুজ ও নাগিরক দলের নেতা মমতাজুলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলায় তারা ভয়ে থানায় অভিযোগ দিতে পারেননি। উপরন্তু হামলাকারি মফিজুল সরদার তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিয়েছে। প্রতিমুহুর্তে তারা নতুন করে হামলা ও মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে রয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওবায়দুর সরদার জানান, শুক্রবার সকালে নিজের ধান খেতে যেয়ে কিছু জমিতে পানি দেখতে না পেয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে কামরুল। পরে তার চাচাত ভাই রবিউলকেও গালি দেয় সে। একপর্যায়ে মসজিদে এসে তার বাবা আব্দুল আজিজকে কটাক্ষ করে। এমনকি জুম্মার নামাজের আগে কামরুল, গোলাম মোস্তফাসহ কয়েকজন লাঠি শোঠা নিয়ে এসে তার বাবা আব্দুল আজিজকে গালি দেয়। কামরুল ইট ছুঁড়ে মারে চাচাত ভাই সিরাজুলকে। নামাজ শেষে তিনিসহ কয়েকজন গোলাম মোস্তফার বাড়িতে গেলে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে তাদেরও চার জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে সিরাজুল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ বাপ্পি জানান, উভয়পক্ষের আহতদের মধ্যে হাসানুজ্জামান ওরফে মাহাবুল্লাহ এবং সিরাজুল ইসলামকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ সামছুল আরেফিন জানান, এ ঘটনায় মফিজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির অভিযোগ দায়ের করেছেন। তদন্ত করার জন্য উপপরিদর্শক সেকেন্দার আলীকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। অপরপক্ষ অভিযোগ দিলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *