শুরুতেই বড় কাটছাঁট হচ্ছে বাজেটে
ডেস্ক রিপোর্ট: রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের কাটছাঁট হতে যাচ্ছে চলতি অর্থবছরের বাজেট। এ মাসের শেষে বা আগামী মাসে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পুনর্বিবেচনার জন্য বৈঠক হতে পারে। এই বাজেট পুনর্বিবেচনার বড় জায়গা হতে পারে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)।
এডিপির আওতায় নেওয়া প্রকল্পগুলো উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এই কাটছাঁটের ক্ষেত্রে প্রধান্য পেতে পারে মেগা প্রকল্প এবং গোষ্ঠী স্বার্থের প্রকল্পগুলো। এতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি কমে যেতে পারে। কারণ জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, দেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে আছে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হচ্ছে। ফলে সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে অপচয়মূলক ব্যয় কমানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে খরচ কমানোর বড় জায়গা হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। এডিপির মধ্যে বড় জায়গা মেগা প্রকল্প।
এ ছাড়া প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলোও পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। সবমিলিয়ে বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেট পুনর্বিবেচনা করা উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় নিয়ে নতুন করে বাজেট সাজানো।
ইতোমধ্যে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও বাজেটের অপচয়মূলক ব্যয় কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি এডিপি সংশোধনেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি এ ব্যাপারে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গত ৯ আগস্ট তিনি বলেছেন, ‘অপচয়মূলক’ উদ্যোগ বন্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এডিপির আওতায় চলমান ও নতুন উভয় ধরনের প্রকল্প যাচাই-বাছাই করবে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ বিভাগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ যৌথভাবে বাজেট যাচাই-বাছাই ও প্রতিবেদন দেবে। যতটা সম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের এটা করতে হবে বলে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
গত ১৯ আগস্টও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দ্বিতীয় দফায় সরকারি ব্যয় কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। ওই সময়ে তিনি উন্নয়ন বাজেট কমানোর সুযোগের কথাও উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমাতে ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হলে সরকারি ব্যয় কমাতে হবে। এই মুহূর্তে সরকারি প্রকল্পে বিশৃঙ্খলা প্রকট। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিছু প্রকল্প আছে যেগুলো এখনো শুরু হয়নি, কিছু মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে এবং কিছু শেষ হওয়ার পথে।’
তিনি আরও বলেন, একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা নতুন প্রকল্পগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাতিল করা হবে। এমনকি চলমান যেসব প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেগুলোতে অর্থ ব্যয় করা হোক বা না হোক, সেগুলোও শেষ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গত ২ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘এ মাসের শেষে বা আগামী মাসে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পুনর্বিবেচনার জন্য বৈঠক হতে পারে। এ ছাড়া বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া প্রকল্পগুলো উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে পুনর্বিবেচনা করা হবে।’
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করে। এর মধ্যে এডিপি ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ছিল ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের বাজেটেই ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা অব্যহৃত ছিল।
এ বছরের বাজেট বরাদ্দও কোনোভাবেই ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। ফলে বড় ধরনের কাটছাঁট করে চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে অন্তত দেড় থেকে ২ লাখ কোটি টাকা সহজেই সাশ্রয় করা সম্ভব। এক্ষেত্রে উন্নয়ন এবং রাজস্ব উভয় খাত থেকেই ব্যয় কমানো সম্ভব। রাজস্ব বাজেটে অনেক অপচয়মূলক ব্যয় বা বাড়তি ব্যয় বরাদ্দ রয়েছে। সেগুলো সহজেই কাটছাঁট করা যায়। অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিক প্রকল্প বাদ দিয়ে উন্নয়ন বাজেট থেকে সহজেই ১ লাখ কোটি টাকার ওপর সাশ্রয় করা সম্ভব।
এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বরাদ্দের মাত্র ১ দশমিক ০৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ বাজেটে বরাদ্দকৃত ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার মধ্যে মাত্র ২ হাজার ৯২২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই মাসে সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা, যা সরকারি তহবিলের বরাদ্দের শূন্য দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে বৈদেশিক সহায়তা খাতের বরাদ্দ থেকে চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ব্যয় হয়েছে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ বা ১ হাজার ২৫১ কোটি টাকা।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারেনিÑ এমন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ।
অন্যদিকে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ বরাদ্দের ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, বিদ্যুৎ বিভাগ ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন বর্তমানে শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিয়ে এডিপি বড় ধরনের কাটছাঁট করলে তেমন কোনো অর্থের অপচয় হবে না। চলতি অর্থবছরে এডিপির আওতায় ১ হাজার ৩২৬টি প্রকল্প আছে। এর মধ্যে অনেকগুলো ২০২৩ সালে অন্তর্ভুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যয় দেখা যায়নি।
যেমন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ১০২টি প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি প্রকল্প নতুন হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো খরচ হয়নি। তাছাড়া একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা অনেক নতুন প্রকল্পের জন্য এডিপিতে আলাদা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
আবার দেশের ৩০০ সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে একটি প্রকল্প জমা পড়েছিল পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক সংসদ সদস্য উন্নয়নের অঙ্গীকার পূরণে ২০ কোটি টাকা করে পাওয়ার কথা। এ ছাড়া প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় ছয়টি করে মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার কথা আরও দুইশ’ মাদ্রাসা নির্মাণের টাকা। পুরো প্রকল্পটিতে খরচ ধরা হয় ৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। এসব প্রকল্প বাদ দিয়ে এখানে অর্থ সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছে একাধিক প্রকল্প আছে যেগুলোতে জনকল্যাণের পরিবর্তে কোনো একটি গোষ্ঠীর কল্যাণ বেশি হবে। এসব প্রকল্পে নেতিবাচক রিপোর্ট দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। প্রভাব খাটিয়ে পরিকল্পনা কমিশন থেকে এসব প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। আমরা সেগুলোর তালিকা তৈরি করছি। যেসব প্রকল্পে জনসম্পৃক্ততা কম সেসব প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে।’
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও সম্প্রতি বলেছেন, মেগা প্রকল্পের বদলে জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখার প্রকল্পে গুরুত্ব দেওয়া হবে। বড় বা মেগা প্রকল্পের অর্থছাড় বড় হয়। তাই এ বিষয়ে পরে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাংলাদেশের অর্থ অপচয় বন্ধ করতে হবে। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ছাড়া কিছু চলবে না।’
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ড. জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজনৈতিক বা প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। কারণ সরকার আর্থিক সংকটে আছে, রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি।
তিনি বলেন, সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। ব্যয় কমানোর বড় জায়গা এডিপি। এডিপির মধ্যে ব্যয় কমানোর বড় জায়গা মেগা প্রকল্প। এক্ষেত্রে মেট্রোরেলের মতো প্রকল্প নেওয়া যায়, কারণ এসব প্রকল্পের চাহিদা আছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে ফিরে আসার সুযোগ নেই।
কারণ এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনেক এগিয়েছে। যেসব মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো সেগুলো শেষ করা ভালো হবে। তবে যেসব মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি বা প্রাথমিক ধাপে আছে সেগুলো বাদ দেওয়া ভালো হবে। এ ছাড়া পল্লি উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক খাতে কিছু ছোট প্রকল্প আছে যেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। এসব প্রকল্প বাদ দেওয়াই ভালো হবে।