Uncategorized

হিমালয়ের বঙ্গসন্তান গৌরী শৃঙ্গের চূড়া

সালেহীন আরশাদী:দুর্গম হিমালয়ে এক বঙ্গসন্তান। প্রচণ্ড জেদে একা চলছেন পথ। কখনো পথ যাচ্ছে হারিয়ে, কখনো শরীরের শক্তি হচ্ছে নিঃশেষ। সেই অম্লমধুর স্মৃতির এক কিস্তি।

ঝকঝকে রোদ উঠেছে। সোনালি আলোয় কুলকুল বয়ে চলা শান্ত নদীটিতে মনে হচ্ছে ফিরোজা রঙের শাড়ি সাজিয়ে রেখেছে কেউ। পরবর্তী গন্তব্য বেদিং পৌঁছাতে হাজার মিটারের মতো চড়াই ঠেঙাতে হবে। তাই সাতসকালে হাঁটতে শুরু করলাম। ভোরের এই সময়টা কেমন যেন অপার্থিব মনে হয়। পাহাড়ের এক ঢাল দিয়ে কাত হয়ে সোনালি আলো নেমে আসে। হালকা হিমভাবে তখনো প্রকৃতির জড়তা পুরোপুরি কাটে না, একই সঙ্গে শুরু হয় বনের পশুপাখিদের হট্টগোল। এই সময়টা পাহাড়ের এক কোনায় চুপচাপ বসে থাকতেই বেশি ভালো লাগে। কিন্তু আজ উপায় নেই, অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।

নদীর তীর ধরে চড়াই উঠছি। মাঝে মাঝে ডান দিকের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝিরি অতিক্রম করতে হচ্ছে। ডোং ডাং ছেড়ে আসার ঘণ্টাখানেক পর রোলওয়ালিং খোলার ওপর একটি সাসপেশন ব্রিজ অতিক্রম করলাম। বিশ মিনিট পর আরেকটি ব্রিজ পড়ল। এই ছোট নদীর নাম মহাদেবখোলা। হিন্দুদের একটি পবিত্র স্থান, নদীর পাড়ে ছোট একটি মন্দির বানানো আছে। মহাদেবের মন্দির হলেও পুরো জায়গা বৌদ্ধদের রঙিন প্রেয়ার ফ্ল্যাগ দিয়ে জাঁকালোভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। খুব ইচ্ছে করছিল ব্রিজ পেরিয়ে ওপারের ঘন অরণ্যের কাছে যেতে।

ঘণ্টা তিনেক টানা ট্রেক করার পর ট্রেইলের মাঝ দিয়ে গৌরী শৃঙ্গের চূড়া ভেসে উঠল। নুড়ি পাথর ও বোল্ডারে ভর্তি ট্রেইল ধরে আরও কিছু চড়াই ওঠার পর আরেকটি শ্বেতশুভ্র পর্বতচূড়া ভেসে উঠল। এর নাম চেকিগো। পর্বতচূড়াগুলো দৃশ্যমান হতেই চারপাশের দৃশ্য বদলে যেতে লাগল। উপত্যকাটি ধীরে ধীরে চওড়া হতে লাগল। দেবদারু, রডোডেনড্রনের জায়গায় জুনিপারের আধিক্য দেখা দিতে লাগল।

প্রকৃতি ও দৃশ্যপটের সঙ্গে বদলাতে থাকল আবহাওয়া। নদী ধরে নিচ থেকে ঘন মেঘের চাদর ভেসে আসছে। দেখতে না দেখতে রোদ ঝলমলে দুপুর মেঘাচ্ছন্ন ঘোলাটে হয়ে গেল। নদীর ওপারের পাহাড় থেকে বেশ কিছু জলপ্রপাত নেমে এসেছে। সেগুলোর গায়ে শুভ্র তুষার লেগে আছে। দেখেই মনে হচ্ছে, ঠান্ডার রাজ্যে চলে এসেছি।জলপ্রপাতের ফাঁকে বড় কয়েকটি গুহামুখ দেখা যাচ্ছে। স্থানীয়দের কাছে শুনেছি, এই গুহাগুলোতে আগে ডাকিনীরা বাস করত। বজ্রগুরু পদ্মসম্ভব এই ডাকিনীদের পরাস্ত করেন। পরে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা লোকালয় থেকে দূরে এই পাহাড়ের গুহাগুলোয় ধ্যান করতেন।

সাত ঘণ্টা চড়াই-উতরাইয়ের পর অবশেষে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শেরপা গ্রাম বেদিংয়ের গেট পাওয়া গেল। তিব্বত থেকে অভিবাসী হওয়া জাতিগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের গ্রামগুলোর প্রবেশপথে একটি গেট থাকবে। গেট বলতে পথের মাঝে দুই দিক খোলা চওড়া একটি ঘর। ঘরের বদ্ধ দুই দেয়ালে সারি সারি প্রেয়ার হুইল লাগানো থাকে। গ্রামে প্রবেশ কিংবা গ্রাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রার্থনামন্ত্র লেখা চাকাগুলো সব ঘুরিয়ে দিতে হয়। এতে গ্রামে শান্তি আর সমৃদ্ধি আসে। আমিও প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে রোলওয়ালিং উপত্যকার সবচেয়ে বড় গ্রাম বেদিংয়ে প্রবেশ করলাম।

পর্বতের ঢালে প্রায় ঝুলে আছে পঞ্চাশ থেকে ষাটটি ঘর। পাশ দিয়েই বয়ে গেছে নদী। নদীর মাঝে চরের মতো জায়গা। সেখানে চরছে শ খানেক ইয়াক। গ্রামের বেশির ভাগ ঘর পাথরে তৈরি। কিছু ঘর খুবই পুরোনো। গ্রামে প্রবেশের মুখে কারুকাজ করা সোনালি ও মেরুনরঙা গুম্ফা দেখতে পেলাম। বেশির ভাগ ঘরের লাল ও নীলরঙা টিনের চালা দূর থেকে দেখতে চমৎকার লাগছে।

কয়েকটি ঘর পেরোতেই কাঙ্ক্ষিত লজটি পেয়ে গেলাম। এ লজ এক মা তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে চালান। তাঁদের ঘরে ঢুকে মনে হলো, আমি বগা লেকে চলে এসেছি! দিদির চেহারা থেকে শুরু করে আপ্যায়ন ঠিক সিয়াম ফুফুর মতো। ফুফুর ঘরের মতোই এখানেও নানা রকম জিনিসপত্র দিয়ে ভর্তি। টুথব্রাশ, সাবান, শ্যাম্পুর মিনি প্যাক, বিস্কুট, কোক, টিস্যু দিয়ে ঘরের একটি অংশ বোঝাই। আরেক অংশে চেয়ার-টেবিল বসিয়ে ডাইন ইনের ব্যবস্থা। আজ অনেক পরিশ্রম হয়েছে, তাই ভাত ও আলুর উমদা তরকারি দিয়ে খেয়ে সেদিনের মতো বিশ্রামে চলে গেলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *