জাতীয়শ্যামনগরসাতক্ষীরা জেলা

একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারানোর খবরে দিশাহারা বক্কার-মহাসিন-বাবুর পরিবার

সুলতান শাহাজান, শ্যামনগর: ঋণের দায়ে ও পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ফেরানোর আশায় শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগরের সোরা, ঈশ্বরীপুরের শ্রীফলকাটি ও আবাদচন্ডিপুরসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকা কালামপুর এলাকার ইট ভাটায় কাজ করতে যাচ্ছিলেন কয়েকজন ইটভাটার শ্রমিক। পথিমধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তারা। এতে তিন ইটভাটা শ্রমিকসহ পাঁচ জন নিহত ও অন্তত ২৭ জন আহত খাওয়ার খবর পাওয়া যায়।

নিহতদের প্রত্যেকেরই আলাদা সংসার রয়েছে। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন আর্থিকভাবে অসচ্ছল। তারাই ছিলেন তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। হঠাৎ করে পরিবারের কাণ্ডারিকে হারানোর খবরে ভবিষ্যতের চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নিহত পাঁচ পরিবারের সদস্যরা।

নিহতরা হলেন- রমজাননগর ইউনিয়নের সোরা গ্রামের মৃত ছাকাত গাজীর ছেলে ভাটা শ্রমিক আবু বক্কার গাজী (৬৫), ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের শ্রীফলকাটি গ্রামেরয়ভাটা শ্রমিক মিজানুর রহমান ওরফে বাবু (৩৫), বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের আবাদচন্ডিপুর গ্রামের বাসের হেল্পার মহাসিন মোড়ল (৩২), পার্শ্ববর্তী কালীগঞ্জ উপজেলার বাজার গ্রাম রহিমপুর এলাকার মনিরুল কারিগরের ছেলে বাসের হেল্পার নাহিদ কারিগর ও অন্য বাসের ড্রাইভার মাগুরা এলাকার পিকুল মোল্লা।

মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) দুপুরে সরেজমিনে শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগরের সোরা, শ্রীফলকাটি ও আবাদচন্ডিপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় প্রিয়জনদের লাশের অপেক্ষায় থাকা পরিবারের সদস্যদের কান্নার দৃশ্য। দুর্ঘটনায় নিহত পাঁচজনের পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। স্বজন হারানোর বেদনায় কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত পরিবারের সদস্যরা।

নিহতদের মধ্যে একজন আবু বক্কর গাজীর বাড়ির রমজাননগর ইউনিয়নের সোরা গ্রামে। ঋনের বোঝা মাথায় চেপে ১২ বছরের পোতা ইয়াসিন আরাফাতকে সাথে নিয়ে ইটভাটায় শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে বাড়ি থেকে বের হন গতকাল সোমবার (১৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায়। বাড়ি থেকে ঢাকার কালামপুর একটি ইটের ভাটায় কাজের জন্য সহকর্মীদের সাথে বের হয়ে মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) ভোরে দুর্ঘটনায় তার চির বিদায়ে পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

নিহত আবু বক্কর গাজীর স্ত্রী সুফিয়া বেগম জানান তাদের এক ছেলে এক মেয়ের সংসার। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে থাকেন। সে (ছেলে) শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাজকাম করতে পারেন না। তাদের ভেটখালী বাজারে একটা চাউলের দোকান ছিল। যেটা মহাজনদের কাছ থেকে সুদের টাকা নিয়ে শুরু করা। সুদের টাকা দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে ব্যবসা বন্ধ করতে হয়। সুদের টাকার ঋনের টাকার জন্য বাধ্য হয়ে ছোট পোতাকে সাথে নিয়ে ইটভাটায় যেতে বাধ্য হন তার স্বামী। গতকাল বিকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছেন তারা দুই দাদা-পোতা। সকালে শুনেছেন তার স্বামী রোড এক্সিডেন্টটা মারা গেছে।

অসুস্থ বাবার সংসারের খরচের জোগান দিতে গতকাল সোমবার (১৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে ঢাকার কালামপুর একটি ইটের ভাটায় কাজের জন্য সহকর্মীদের সাথে রওনা হন তিনি। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) ভোরে দুর্ঘটনায় তার চির বিদায়ে পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

শ্রীফলকাটি গ্রামে স্ত্রী ও ১২ ও ৫ বছরের দুই মেয়েকে রেখে মারা গেছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মিজানুর রহমান ওরফে বাবু। সেও একইভাবে ঋণের চাপে স্ত্রী সন্তানদেরকে সাথে নিয়ে ইটভাটায় যাচ্ছিলেন। এতে তার ছোট মেয়েও মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।

নিহত বাবুর বাড়িতে গেলে তার মা রাবেয়া খাতুন জানান, ছেলেটা ঋণের চাপে বাড়িতে থাকতে পারে না। বউ মেয়েদের বাড়িতে রেখে সে সব সময় বাড়ির বাইরে থাকতেন পালিয়ে। এবার বাধ্য হয়ে স্ত্রীর সন্তানদের সাথে নিয়ে ভাটায় যাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। ওর বাপও মারা গেছে তিন বছর হলো। এখন তার ঋণ কে শোধ করবে?

বাসের হেলপার মহাসিন মোড়ল (৩২) গতকাল সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। এরপর রাত নয়টায় শেষ কথা হয় তার স্ত্রী আরজা খাতুনের সঙ্গে। সে (নিহত মহাসিন) জানাই ভেটখালী থেকে ইট ভাটার শ্রমিকদের নিয়ে ঢাকার কালামপুর যাচ্ছেন তিনি। এরপর পরিবার সকালে খবর পায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

নিহত মহাসিন এর বৃদ্ধ পিতা আনসার আলী জানান, তিন ছেলের মধ্যে সবার ছোট মহাসিন। গাড়ির হেলপারি করে। তার পরিবারের স্ত্রী ও একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ফরিদপুর সদরের মল্লিকপুরে করিমপুর জোড়া সেতুর কাছে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ঢাকা থেকে ঝিনাইদহগামী গ্রিন এক্সপ্রেস নামের একটি বাসের সঙ্গে সাতক্ষীরা থেকে আমতলীগামী আরেকটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ইটভাটা শ্রমিক ও বাসের ড্রাইভার ও হেল্পারসহ পাঁচজন নিহত হয় এছাড়াও অন্তত ২৭ জন আহত খাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে নিহত পাঁচজনের মধ্যে তিনজনের বাড়ি শ্যামনগরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *