প্রাথমিকে জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কর্মকর্তা হওয়ার গল্প শোনালেন এইচ এম রোকনুজ্জামান
কলারোয়া প্রতিনিধি: প্রাথমিক শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য সরকার প্রতিবছর প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০২৪ প্রদান করে। এ বছর সাতক্ষীরা জেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়েছেন কলারোয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এইচ এম রোকনুজ্জামান।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার পক্ষ থেকে সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ তথ্য জানা গেছে। জেলার শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়ার পরে দৈনিক কালের চিত্রের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকার দিয়েছেন এইচ এম রোকনুজ্জামান। শুনিয়েছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার পেছনের গল্প। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন দৈনিক কালের চিত্র পত্রিকার কলারোয়া প্রতিনিধি।
সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলায় প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। আর এই শিক্ষার্থীদের পাঠদানে সহযোগিতা করেন ১২৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭৪৬ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামগত উন্নয়ন, শিক্ষা উপকরণের চাহিদার বাস্তবায়ন ঘটানো ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ সবকিছুর দেখভাল করার জন্য সার্বক্ষণিক তদারকিতে রয়েছেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা।
দৈনিক কালের চিত্র: সাতক্ষীরা জেলায় প্রাথমিকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের গল্প, উপজেলায় যোগদানের সময় প্রাথমিক শিক্ষার মান, অবকাঠামো ও শিক্ষার পরিবেশ এবং কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
এইচ এম রোকনুজ্জামান: আমি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মত তেমন কেউ নই। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন করার লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবেই কাজ করছি। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের ১১ তারিখে কলারোয়া উপজেলায় শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়ায় যার মধ্যে অন্যতম ছিল ১. বিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ শিক্ষার্থীবান্ধব না থাকা, ২. বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নিয়মিত না হওয়া, ৩. উপজেলা শিক্ষা অফিস অপরিচ্ছন্ন থাকা, ৪. বিদ্যালয় চলাকালীন শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা, ৫. অকারণে প্রধান শিক্ষকদের উপজেলা শিক্ষা অফিসে যাতায়াত, ৬. শিক্ষকদের ন্যায়সংগত কোন কাজের নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা, ৭. শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেশি থাকা, ৮. উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে সেবামূলক দপ্তরগুলোর দূরত্বসহ আরও নানা বিষয়। প্রাথমিকভাবে এসব চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাকে।
দৈনিক কালের চিত্র: প্রাথমিকে এসব সমস্যা দেখার পর চ্যালেঞ্জগুলো আপনি কিভাবে সমাধানের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?
এইচ এম রোকনুজ্জামান: উপজেলার সব শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের সাথে বসে বিভিন্নভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজেছি। এটা কখনো একার পক্ষে সম্ভব নয়, সকলের সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধতাই সকল উন্নয়নের মূল শক্তি। এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণের বেশ কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ১, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের উপস্থিতিতে মাসিক সভায় বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে স্পষ্ট এজেন্ডাভিত্তিক আলোচনা ও জোরালো নির্দেশনা দেয়া। ২. পরিদর্শন কার্যক্রম ইউইও ও এইউইও জোরদার করার মাধ্যমে শিক্ষকদের বিদ্যালয়মুখী করা। ৩. উপজেলা শিক্ষা অফিস ও বিদ্যালয়গুলোর সার্বিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দৃষ্টিনন্দনভাবে বাস্তবায়ন করা, ৪. উপজেলা শিক্ষা অফিস ও অন্য কোথাও শিক্ষকদের অহেতুক যাতায়াত বন্ধ করতে সুস্পষ্টভাবে রেজিস্টার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। এতে করে শিক্ষকদের সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কমে আসে। এছাড়াও উপজেলা শিক্ষা অফিসে শিক্ষকদের অকারণে ঘন ঘন যাতায়াতের প্রবণতা বন্ধে শিক্ষা অফিসে আসার কারণ লিপিবদ্ধ করার রেজিস্টার খোলা হয়েছে। ৫. সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি। ৬. প্রাথমিক পর্যায়ে বাবা ও মায়েদের শিক্ষার্থীদের প্রতি আরও যত্নশীল করতে ‘মা সমাবেশ’ জোরদার করা হয়েছে। একই সাথে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষা কর্মকর্তাসহ অভিভাবকের বাড়িতে হোম ভিজিট ও উঠান বৈঠক কার্যকর করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হয়েছে। ৭. উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদ, প্রশাসন, স্বাস্থ্যসেবা দপ্তর, জনস্বাস্থ্য দপ্তর, প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের সাথে সমন্বয় করে প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ দৃশ্যমান উন্নয়ন ও উন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছে। ৮. উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সাথে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও অফিস স্টাফদের কাজের চমৎকার সমন্বয় নিশ্চিত করা হয়েছে। ৯. দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সাবলীল গঠন দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ে সাবলীল পড়তে পারে না এমন শিক্ষার্থীর তালিকা করে বিদ্যালয়ভিত্তিক দায়িত্ব বন্টন ও নিরাময়মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পর সাবলীলভাবে পড়ার অগ্রগতির পরিমাণ টুলসের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। ১০. বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর শুদ্ধাচার চর্চা নিবিড়ভাবে করার লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয় শুদ্ধাচার চর্চার কৌশল সম্মিলিত ফেস্টুন তৈরিসহ শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
দৈনিক কালের চিত্র: প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে কোন দিকটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এইচ এম রোকনুজ্জামান: প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমে প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান। শিক্ষার্থীদের শিষ্টাচার, নম্রতা, ভদ্রতা, ধর্মীয় জ্ঞান চর্চা করাতে হবে পাশাপাশি সংস্কৃতি ও খেলাধুলায়ও তাদের অংশগ্রহণ করাতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সহকারী শিক্ষকরা মিলেমিশে তাদের প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই সৌন্দর্য বর্ধন করতে এবং শিশুদের মনন আকৃষ্ট করতে সকলে মিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মনোরম করে গড়ে তুলতে হবে । এজন্য শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিক্ষিকা, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থী সকলের চেষ্টা প্রয়োজন। তা নাহলে একজন শিক্ষা কর্মকর্তার দ্বারা কখনোই সম্ভব হবে না, তাতে যতই পরিকল্পনা থাকুক। সকলের সুন্দর পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় অবশ্যই প্রাথমিক শিক্ষার মানকে আরও উন্নত করা সম্ভব। তখন শ্রেষ্ঠত্ব শুধু নিজ উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় বলে নয়, জাতীয় পর্যায়েও নিজের প্রতিষ্ঠানকে সবাই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারবেন।
দৈনিক কালের চিত্র: এতোক্ষণ ধরে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
এইচ এম রোকনুজ্জামান: অসংখ্য উন্নয়নমুখী কার্যক্রম এই উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে করে যাচ্ছি। শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে উপজেলা শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষা অফিসের সকল কর্মকর্তা, সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক এবং এমনকি শিক্ষার্থীরাও। যে কারণে আজ হয়তো সাতক্ষীরা জেলার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য মূল্যায়িত হয়েছি। শুধু আমি নই, এবারে সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন কলারোয়ার রামভদ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালেয়ের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল ইসলাম, শ্রেষ্ঠ কাব শিক্ষক হয়েছেন কলারোয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক অনুপ কুমার ঘোষ। শিক্ষায় কলারোয়ার এমন অর্জন অবশ্যই এলাকার জন্য সুনাম বয়ে আনছে। তবে আমার পরিকল্পনায় রয়েছে, যেখানেই দায়িত্ব পালন করি না কেন প্রতিটি শিক্ষার্থীই আমার সন্তান, প্রতিটি কর্মকর্তাই আমার সহকর্মী, আমার ভাই। সকলে মিলে সকলের সমন্বয়ে একটি সুন্দর শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে চাই যা এলাকায় শিক্ষার এক অপরূপ সৌন্দর্য বহন করবে। আপনাদের মাধ্যমে সারাদেশের কাছে কলারোয়ার শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিচিত করার জন্য আপনাকে ও আপনার প্রতিষ্ঠানকেও ধন্যবাদ।