সাতক্ষীরা পৌরসভার সাবেক প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু
স্টাফ রিপোর্টার: সাতক্ষীরা পৌরসভার সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিমউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতা ও সেবাগ্রহীতাদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে তদন্ত করে সেই কর্মকর্তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে পৌরবাসী।
পৌরসভা সূত্র জানায়, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে নাজিমউদ্দীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। এরপর তার অনিয়ম ও দুর্নীতি অভিযোগ উঠে। এর আগে তিনি কুড়িগ্রামের আরডিসি ও কক্সবাজারের এসিল্যান্ড থাকাকালে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্যও ব্যাপক সমালোচিত ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে কক্সবাজারে দায়িত্ব পালনের সময় বয়স্ক ব্যক্তিকে কান ধরে টেনে লাঞ্ছিত করে দেশব্যাপী ব্যাপক নিন্দার মুখে পড়েন নাজিমউদ্দিন।
এছাড়াও তিনি পৌরসভায় যোগদান করেই পানি সরবরাহ বিভাগে মাস্টাররোলের ২৭ কর্মচারিকে কোনো কারণ ছাড়াই বেতন বন্ধ করে দেন। এ সকল অভিযোগের জন্য তাকে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
পানি বিভাগের কর্মচারি বাপ্পী আহমেদ বলেন, ‘আমরা পানিবিভাগের মাস্টাররোলের কর্মচারি। সিইও নাজিম আসার পরের মাস থেকে কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের বেতন বন্ধ করে দেন। সেই বেতন চাইতে গেলে গুলি করে হত্যার হুমকি দেন। সেই থেকে মানবেতর জীবন-যাপন করছি। তিনি প্রচণ্ড দুর্নীতিবাজ। আমরা তার বরখাস্ত দাবি করছি।’
পৌরসভায় চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য ৭ ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আছে নাজিমউদ্দীন বিরুদ্ধে। ২ বছর পার হলেও কারও চাকরি দেননি তিনি, টাকাও ফেরত দেননি।
এ প্রসঙ্গে পৌরসভার মুন্সিপাড়া এলাকার বাসিন্দা বিরাজ হোসেন বলেন, ‘চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়েছিল সিইও নাজিম। সেই টাকা ফেরতও দেয়নি, চাকরিও স্থায়ীকরণ করেনি।’
নাজিমউদ্দীনের সময়ে ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইল নড়েনি পৌরসভায় এমনটা জানিয়ে, কোরাইশী ফুড পার্কের স্বত্বাধিকারী আনিছুর রহমান কোরাইশী বলেন, ‘ রেস্টুরেন্টের ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের জন্য যারপরনাই হয়রানি করেছিলেন নাজিম ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র ফিরোজ হাসান। অগত্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স করা হয়।’
গণমাধ্যমকর্মীরাও তার দুর্ব্যবহার ও লাঞ্চনা থেকে রেহাই পাননি। তার বিরুদ্ধে মাদক সেবনের অভিযোগ এনে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার একজন সাংবাদিক বলেন, ‘অসহায় একজন ব্যক্তির প্রয়োজনে আমি সাতক্ষীরা পৌরসভায় যাই। কিন্তু সে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আসলে সে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মাদকাসক্ত মানুষ। কিছু বাটপারকে ম্যানেজ করে সে মূলধারার গণমাধ্যমকর্মীদের চরমভাবে নাজেহাল করেছে। আমরা চাই সে যেন বাংলাদেশের কোথাও পোস্টিং না পায়।’
বিএনপি থেকে নির্বাচিত মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতিকে চেয়ারে বসতে দেননি নাজিম। কাউন্সিলরদের হাত করে ফিরোজ হাসানকে বানিয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত মেয়র। এরপর থেকে নাজিমউদ্দীন ধরাকে সরাজ্ঞান করতে থাকেন। তাকে অপসারণের দাবিতে মানববন্ধনসহ একাধিকবার আন্দোলন হয়েছে সাতক্ষীরায়। তার বিরুদ্ধে তদন্তও হয়েছে। কিন্তু এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে বহাল তবিয়তে চাকরি করেছেন সাতক্ষীরা পৌরসভায়।
ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে ২ কোটি টাকারও বেশি অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। গত সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা তাজকিন আহমেদ চিশতি স্থানীয় সরকার বিভাগে তাদের বিরুদ্ধে ৯টি অভিযোগ দাখিল করেন।
অভিযোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ভুয়া প্রকল্পের নামে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা আত্মসাৎ, আর্থিক অনুদানের নামে ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ, অর্থ বানিজ্যের মাধ্যমে পৌরসভার ১৪ জন কর্মচারি নিয়োগ।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পৌরসভার সাবেক মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতি বলেন, ‘আওয়ামী সরকারের আমলে আমি বিভিন্ন ছলে হয়রানি হয়েছি। সিইও নাজিমউদ্দীন আর ভারপ্রাপ্ত মেয়র ফিরোজ পেশি শক্তি দেখিয়ে আমাকে পৌরসভায় আসতে দেননি। শক্তিশালী সিন্ডিকেট করে এক বছরের মধ্যে তারা ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা তারা আত্মসাৎ করেছে। ঠিকাদাররা স্টেটমেন্ট দিয়েছে। এ সব প্রকল্পের কাজ তারা করেনি।’
বিভিন্ন অনিয়মের কারণে চলতি বছরের ১৩ জুন স্থানীয় সরকার বিভাগ নাজিমউদ্দীনকে ভোলা পৌরসভায় বদলির আদেশ দেয়। তবে সে আদেশ অগ্রাহ্য করে ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত বহাল তবিয়তে সাতক্ষীরা পৌরসভায় অফিস করেছেন তিনি।
নাজিমউদ্দীন ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র ফিরোজ হাসানের বিরুদ্ধে সাবেক মেয়রের আনীত অভিযোগ তদন্ত করে গত ৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মাহবুব আলম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে মন্তব্যসহ প্রতিবেদন দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনা মোতাবেক তদন্তকাজ শুরু করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতা সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মাশরুবা ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘পৌরসভার সিইও ও পৌর কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্থানীয় সরকার বিভাগে দেওয়া হয়েছে। সেটার তদন্তভার আমার ওপর। তদন্ত শুরু করেছি। যতদ্রুত সম্ভব মন্তব্যসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেব।’
সবশেষ জানা যায়, অন্তবর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর ৬ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে সেখান থেকে সরিয়ে ৮ সেপ্টেম্বর তাকে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।