অনলাইনঅপরাধআইন আদালতআন্তর্জাতিকসদরসাতক্ষীরা জেলাসারাবাংলা

ভোমরার মাদক সম্রাট শামীম: দুই যুগের সিন্ডিকেটে নাকানিচুবানিতে প্রশাসন

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর—যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বৈধ আমদানি-রপ্তানি হয়। কিন্তু এ সীমান্ত এখন অবৈধ বাণিজ্যের জন্যও কুখ্যাত। ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইনসহ নানা মাদক এখান দিয়ে আসছে প্রতিদিন। এই সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আছেন শামীম হোসেন, স্থানীয়দের চোখে যিনি “মাদক সম্রাট শামীম” নামে পরিচিত।

শামীমের উত্থান হঠাৎ করে নয়। তার বাবা কুখ্যাত আরশাদ আলী ভোদু ছিলেন সীমান্তের পুরনো ব্লাকার। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি প্রকাশ্যে টুপি পরে ফেন্সিডিল বিক্রি করতেন এবং মাদককে ‘হালাল ব্যবসা’ হিসেবে মনে করেন। পরিবারের স্ত্রী-সন্তান, জামাতা ও আত্মীয়স্বজন সকলেই চোরাচালান ও মাদকের সাথে যুক্ত ছিল। ফলে ভোমরা সীমান্তে এই পরিবার ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটে পরিণত হয়।

বাবার উত্তরসূরি হয়ে শামীম এখন পুরো নেটওয়ার্কের প্রধান। তার অধীনে শতাধিক দালাল ও বাহক কাজ করে। স্থানীয় সূত্র বলছে- প্রতিদিন ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার মাদক লেনদেন হয়। ভোমরা সীমান্ত দিয়ে আসা চালান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সাথে রয়েছে তার গভীর যোগসূত্র।

গত ৮ জুন ভোমরা সীমান্ত থেকে শামীমকে বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিলসহ আটক করে বিজিবির একটি বিশেষ দল। কিন্তু গ্রেপ্তারের পরপরই শামীমের পরিবার ও আত্মীয়রা বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও অপপ্রচার শুরু করে। শামীমকে আটকের পর বিজিবি সদস্যরা রীতিমত একরকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। শামীমের মা বোন ও তার আত্মীয় স্বজনরা সকালে একবার আবার বিকেলে একবার বিজিবির বিরুদ্ধে মানববন্ধন, সমাবেশ ও বিক্ষোভ নিয়ে টানা দুই সপ্তাহ ধরে বিজিবির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। কর্মরত বিজিবি সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন নারীকে জড়িয়ে কল্পকাহিনী ছড়াতে থাকে। বিজিবি সদস্যকে নিয়ে অপপ্রচার চালালেও নারী ঘটিত বিষয়ে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি ওই বিজিবি সদস্যের নামে। যা একটি পরিকল্পিত সাজানো নাটক যাতে করে তারা মাদক সাম্রাজ্য নির্বিঘ্নে চালাতে পারে। প্রশাসন তাদের গ্রেফতার করতে, বা মাদক বিক্রিতে কোন প্রকার বাধা প্রদান না করতে পারে। তবে, দুই সপ্তাহ টানা চাপ-প্রভাবে শেষ পর্যন্ত লাখ লাখ টাকা খরচ করে অবশেষে জামিনে মুক্ত হয় শামীম।

এটি তার প্রথমবার নয়- এর আগে ডজনখানেক মামলায় গ্রেপ্তার হলেও প্রতিবার জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। বর্তমানে জামিনে থেকে আবারও পুরনো ব্যবসায় ফিরে গেছেন।

ভোমরার সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনের একধরণের নিষ্ক্রিয়তায় মাদক ব্যবসায়ীরা দিন দিন আরও শক্তিশালী হচ্ছে।

বিজিবির ৩৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশরাফুল হক বলেন- আমরা প্রতিদিন মাদকবিরোধী বিশেষ টহল পরিচালনা করছি। প্রচুর মাদক জব্দ করা হচ্ছে। সীমান্তে অপরাধরোধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন- ভোমরা সীমান্তের ৮ কিলোমিটার পুরোপুরি বিজিবির নিয়ন্ত্রণে। তবুও আমরা মাদক দমনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। মাদকের ব্যাপারে পুলিশ সব সময় জিরো টলারেন্স।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শামীম প্রতি মাসে জেলার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মোটা অঙ্কের টাকা দেন। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক সময় নীরব থাকে। জনপ্রতিনিধিদের একটি অংশ এই সিন্ডিকেটের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকার অভিযোগও স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়।

মাদকের অবাধ বাণিজ্য সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে দুর্যোগ। যুব সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই ও নারী নির্যাতনের মতো অপরাধ বাড়ছে। পারিবারিক কলহ ও সামাজিক অবক্ষয় ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

সচেতনমহল মনে করে- মাদক প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি— কোনো প্রভাবশালী মহলকে ছাড় দেওয়া যাবে না। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, সীমান্তবাসীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। যৌথ বাহিনী অভিযান চালাতে হবে- বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব ও কাস্টমসের সমন্বয়ে। আইন সংস্কার করে জামিনে বেরিয়ে পুনরায় অপরাধে জড়ানোর সুযোগ বন্ধ করতে হবে।

শামীম কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি সীমান্তের দীর্ঘদিনের মাদক চক্রের প্রতীক। প্রশাসনের চেষ্টায় সাময়িকভাবে ধরা পড়লেও প্রভাব-প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আবারও মুক্ত হয়ে যান। স্থানীয়দের মতে- সৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া ভোমরার মাদক সাম্রাজ্য ভাঙা সম্ভব নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *