কালিগঞ্জের আলোচিত প্রধান শিক্ষক বাবলুর বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারীর তদন্ত শুরু
স্টাফ রিপোর্টার: অর্ধ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য, নারী কেলেঙ্কারি, ছাত্রীদের যৌন হয়রানি,নিজ কক্ষকে দলীয় অফিস বানানো সহ নানাবিধ দুর্নীতির ঘটনায় সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার উজ্জীবনী ইনস্টিটিউট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত সাবেক উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা, প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলুর বিরুদ্ধে ছাত্র-ছাত্রী ,অভিভাবক ,এলাকাবাসীর অভিযোগের তদন্ত শুরু।
গত ১/২/২০২৫ ইং তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা, খুলনা বিভাগীয় উপ -পরিচালকের নিকট অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২৩/৩/২৫ ইং তারিখে খুলনা বিভাগীয় মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত ৩৭.২০.৪৭০০.০০০.০১.০০১.০১.২৫-৪০৪৬ নং স্মারকে ৭ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশ থাকলেও রহস্যজনক কারণে ৬ মাস পর অবশেষে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় উপ-পরিচালকের নির্দেশে গত রবিবার (২০ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১ টার সময় বিদ্যালয় ভবনে তদন্তকারী দলের আহবায়ক কালিগঞ্জ উপজেলার সরকারি পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (ভারপ্রাপ্ত) প্রধান শিক্ষক আবুল হাসান ও সদস্য শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর সরকারি হরিচরণ পাইলট মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (ভারপ্রাপ্ত) প্রধান শিক্ষক শাহাদাত হোসেন নানান তালবাহানার পর এ তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন।
ঘটনার পরপরই উজ্জীবনী ইনস্টিটিউট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুজা মণ্ডলের গঠিত প্রাথমিক তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আকরাম হোসেন গত (২৬ মে) মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে যৌন হন্তারক, দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলুকে বাঁচাতে তার পক্ষে প্রতিবেদন দেওয়ার গুঞ্জনকে কেন্দ্র করে এলাকায় ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক এবং এলাকাবাসীর মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।
এ বিষয়ে সত্য ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করা হলে আবারো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন এলাকাবাসী।
এ কারণে গত শনিবার দিনভর নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে এলাকাবাসী মাইকিং করে সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানান।
তদন্ত কার্যক্রমের সময় উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের নিজদের পুর গ্রামে অবস্থিত উজ্জীবনী ইনস্টিটিউট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের যৌন হয়রানির শিকার ভুক্তভোগী আছিয়া, মরিয়ম ,লামিয়া, সহ নিয়োগে ঘুষ প্রদানকারী ভুক্তভোগী নিরাপত্তা কর্মী মনিরুল ইসলাম, পরিচ্ছন্ন কর্মী ফরিদ উদ্দিন ,অফিস সহায়ক আজিজুর রহমান ,নৈশ প্রহরী ইয়াসিন এবং সহ প্রধান শিক্ষক বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাহমুদুন্নবী ছাড়াও বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শামীম আক্তার, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ইউপি সদস্য আবু তাহের, ভুক্তভোগী শিক্ষক মুস্তাহিদুল ইসলাম লিটন, হাফিজুর রহমান আব্দুল কবির, স্বপন কুমার বর্মন, আব্দুস সাত্তার, সিরাজুল ইসলাম, মাওলানা আজিজুর রহমান সহ অভিভাবক ,এলাকাবাসী, সুধী, সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত থেকে তদন্ত কর্মকর্তা দের সম্মুখে প্রধান শিক্ষকের নানান দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি ও ছাত্রীদের যৌন হয়রানির বিষয়টি তুলে ধরে লিখিত জবানবন্দি দাখিল সহ প্রমাণস্বরূপ পেনড্রাইভে ছবি, ভিডিও তদন্ত কর্মকর্তার নিকট হস্তান্তর করেন।
তদন্ত কার্যক্রম শেষে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক এবং সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তদন্ত কর্মকর্তা আবুল হাসান বলেন প্রকৃত সত্য ঘটনা উদঘাটন করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। তবে আরো কিছু তদন্তের কাজ বাকি আছে সেটা তদন্ত করে পূর্ণ প্রতিবেদন দাখিল করবো।
বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এলাকাবাসীর লিখিত অভিযোগের সূত্রে জানা যায় বিগত আওয়ামী সরকারের সময় ২০১৭ সালে অত্র বিদ্যালয়ের ম্যানেজিংকমিটি গঠনে পাতানো নির্বাচনে প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলু তার আপন ফুফাতো ভাই আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ কবীর কাজলকে সভাপতি করে। এরপর প্রভাব খাটিয়ে ১৯/৩/২০১৮ ইং তারিখে ঐ বিদ্যালয়ে ইকবাল আলম বাবলু প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করে।
প্রধান শিক্ষক নিয়োগ লাভের পর থেকে বিদ্যালয়ের রেজুলেশন খাতা সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিজে কুক্ষিগত করে রাখে। বিদ্যালয়ে ৫ টি পদে নিয়োগের জন্য বিদ্যালয় ফান্ডে জমার নামে নিরাপত্তা কর্মী মনিরুল ইসলামের নিকট থেকে গত ১৪/১/২০১৯ ইং তারিখে ৭ লক্ষ, পরিচ্ছন্ন কর্মী ফরিদ উদ্দিনের নিকট থেকে গত ১/৬/২০২২ ইং তারিখে ৯ লক্ষ, অফিস সহায়ক আজিজুর রহমানের নিকট থেকে ৬/৬/ ২০২২ ইং তারিখে ৯ লক্ষ ,নৈশ প্রহরী ইয়াসিন আলীর নিকট থেকে ১২/৮/২০২২ ইং তারিখে ৫ লক্ষ এবং সহ প্রধান শিক্ষক বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাহমুদুন্নবীর নিকট থেকে গত ১/৬/২০২৩ ইং তারিখে ৬ লক্ষ টাকা পরস্পর যোগসাজসে ঘুষ নেয় বলে স্বীকারোক্তিমূলক লিখিত জবানবন্দি সহ অভিযোগে বলা হয়েছে। অএ বিদ্যালয়ৈ যোগদানের আগে প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলু কালিগঞ্জ পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করা কালীন এক ছাত্রীর সঙ্গে অবৈধ মেলামেশায় গর্ভপাত ঘটনার অপরাধে ঐ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বরখস্ত করে। পরে ঘটনা ধামাচাপা ও চাকরি বাঁচাতে তৎকালীন ঐ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতাকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে রেহাই পায়।
তাছাড়া বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তার (প্রধান শিক্ষক) অফিস কক্ষকে প্রমোদকুঞ্জ ও দলীয় অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন। নিজে সপ্তাহে ২/১ বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া ছাড়া বাকি সময়টা খেলাধুলার নামে অনুপস্থিত থেকেও ঠিকই হাজিরা খাতায় হাজিরা দেখিয়ে বাকি শিক্ষকদের উপর প্রভাব খাটিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে দলীয় ক্যাডার দিয়ে শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত হয়রানি সম্মানহানি করা হতো।
নারী লিপ্সু প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলু তার স্ত্রী, ২ সন্তান রেখে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর শ্যামনগর থানার হায়বাত পুর গ্রামের একটি ভাড়া বাসাতে বিবাহিত হিন্দু পরের স্ত্রী এক ছাত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে মোটা অংকের টাকা দিয়ে সে যাত্রায় ছাড়া পায়। উক্ত ঘটনার ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয় ২০২৪ সালে ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে কিছুদিন পালিয়ে থাকার পরে পরিস্থিতি বুঝে আবার স্কুলে যাতায়াত শুরু করে। গত ৩০/১০/২০২৪ ইং তারিখে নবম শ্রেণীর ২ ছাত্রীকে জন্মদিন পালনের জন্য নিজ খরচে কেক কিনে ছুটির পরে সবাই চলে যাওয়ার সুযোগে ওই ছাত্রীদের জোরপূর্বক যৌন হয়রানি করে। ছাত্রীরা প্রতিবাদ করায় উল্টো বিভিন্ন হুমকি দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১৮/১১/২০২৪ ইং তারিখে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবক এলাকাবাসী লম্পট প্রধান শিক্ষকের অপসারণের দাবিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে তার কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে এসিল্যান্ড অমিত কুমার বিশ্বাস,সেনা ক্যাম্পের সদস্য ও পুলিশের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে নিরাপত্তা হেফাজত নিয়ে জীবন রক্ষা করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে গত ১৯ নভেম্বর তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট ছাত্রছাত্রী অভিভাবকরা এসে লিখিত অভিযোগ দিতে গেলে না নেওয়ায় ২০ নভেম্বর বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে জানায়।
জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ঐ দিনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিযোগ গ্রহণ করে গত ২১ নভেম্বর প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।
বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং পত্র-পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন ছড়িয়ে পড়লে গত ৫ জানুয়ারি সাতক্ষীরা ছাত্র আন্দোলনের জেলা ছাত্র সমন্বয়কের সভাপতি আরাফাত হোসেন এবং সম্পাদক রনির নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সরেজমিনে বিদ্যালয়ে এসে ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগ জেনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানা অফিসার্স ইনচার্জের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।