অনলাইনঅপরাধআইন আদালতকালিগঞ্জসাতক্ষীরা জেলা

কালিগঞ্জ ইউসিসিএতে ভয়াবহ লুটপাট-উধাও পরিদর্শক আব্দুস সালাম

তাপস কুমার ঘোষ, কালিগঞ্জ: কালিগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি)-এর আওতাধীন উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি (ইউসিসিএ) লিমিটেডে সংঘটিত এক ভয়াবহ অর্থ কেলেঙ্কারিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, ইউসিসিএ’র পরিদর্শক আব্দুস সালাম বিভিন্ন কৃষক সমবায় সমিতির কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করে গা ঢাকা দিয়েছেন। এই ঘটনায় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের দুই শতাধিক দরিদ্র ও প্রান্তিক কৃষক সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে সামাজিক ও আর্থিক সংকটে পড়েছেন।

ভুক্তভোগী সমবায়ী ও কৃষকদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক আব্দুস সালাম বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সমিতির সভাপতি, ম্যানেজার ও সাধারণ সদস্যদের কাছ থেকে নগদ অর্থ আদায় করতেন। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের অজান্তেই তাদের নামে ঋণ উত্তোলন করে সেই অর্থ আত্মসাৎ করেন তিনি। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর একটি প্রভাবশালী সুবিধাভোগী চক্র তাকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অন্যদিকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় উল্টো ফাঁসানো হয়েছে কালিগঞ্জ উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসার শেখ জাহাঙ্গীর আলমকে এমন অভিযোগ করেছেন সমবায় নেতারা। তারা জানান, শেখ জাহাঙ্গীর আলম যোগদানের পর ইউসিসিএ ও বিআরডিবির আওতাধীন বিভিন্ন প্রকল্পে দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির তথ্য উদ্ঘাটনে উদ্যোগ নেন। খেলাপি সমবায় সমিতিগুলোর প্রকৃত অবস্থা নিরূপণে তিনি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পরিদর্শক আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি বিভিন্ন সমবায় সমিতি থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, ব্যাংক চালান জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করেছেন এবং সেই অর্থ দিয়ে স্ত্রীর নামে আলীশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২৩ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ইউসিসিএ লিমিটেডের কর্মচারীদের মডেল চাকরি প্রবিধানমালা-২০১৮-এর ২৬(১) ধারা অনুযায়ী আব্দুস সালামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

তবে অভিযোগ রয়েছে, বরখাস্তের আদেশটি ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রাখা হয় এবং কৌশলে তার হাতে পৌঁছাতে বিলম্ব ঘটানো হয়। এই সুযোগে আব্দুস সালাম আত্মগোপনে চলে যান। একই সময়ে একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসার শেখ জাহাঙ্গীর আলমকে বদলি করাতে তৎপর হয়।

ভুক্তভোগীদের দাবি, অভিযোগকারীদের স্বাক্ষর ছাড়াই একটি কাল্পনিক আবেদন তৈরি করে তাতে সাবেক সংসদ সদস্য কাজী আলাউদ্দীন, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এইচ এম রহমাতুল্লাহ, উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শেখ এবাদুল ইসলাম, উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আব্দুর রউফ ও ছাত্র নেতা শেখ রাকিবের স্বাক্ষর ও সিল জাল করে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকের কাছে জমা দেওয়া হয়। ওই জাল আবেদনের ভিত্তিতেই শেখ জাহাঙ্গীর আলমকে কালিগঞ্জ থেকে বদলি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর উপজেলার বিভিন্ন কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি, সদস্য, ইউসিসিএ’র পরিচালক ও কেএসএস পরিচালকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। খরিতলা কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি রুমি ও কৃষক মো. আশরাফ হোসেন জানান, “দীর্ঘদিন ধরে আব্দুস সালাম আমাদের সমিতিতে টাকা কালেকশনের দায়িত্বে ছিল। আমরা তার ওপর আস্থা রেখেছিলাম। সেই সুযোগে সে আমাদের সমিতিসহ অন্য সমিতির টাকা আত্মসাৎ করেছে। অনেক কৃষক জানেই না তাদের নামে ঋণ উঠেছে। তাদের দাবি, শুধু খরিতলা সমিতি থেকেই প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

একই অভিযোগ করেন সাদপুর কৃষক সমবায় সমিতির সভাপতি ডা. আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, “আমাদের সমিতি থেকে প্রায় ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং সব মিলিয়ে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা বিভিন্ন সমিতি থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে। ভুক্তভোগী কৃষকরা আরও অভিযোগ করেন, বরখাস্তের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও অফিসের কিছু কর্মকর্তা সাসপেনশন লেটার গোপন রেখে অভিযুক্তকে পালিয়ে যেতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন।

এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত সমবায়ী ও কৃষকরা অবিলম্বে কালিগঞ্জ উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসার শেখ জাহাঙ্গীর আলমকে পুনর্বহাল, অর্থ আত্মসাতকারী পরিদর্শক আব্দুস সালামকে দ্রুত গ্রেপ্তার, আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধার এবং পুরো ঘটনার সঙ্গে জড়িত ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিদর্শক আব্দুস সালামের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *