সাতক্ষীরা রেঞ্জের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কৌশলে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ
গাজী হাবিব: পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের দুই কর্মকর্তা- রেঞ্জ সহকারী এ.বি.এম হাবিবুল ইসলাম ও বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে জেলে ও বাওয়ালী মহাজনদের কাছ থেকে কৌশলে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ, সুন্দরবনের অভয়ারণ্যের ভেতর নৌকা চলাচলের অনুমতি, পাস নবায়ন এবং বিভিন্ন ধরণের সরকারি ফি আদায়ের নামে অতিরিক্ত টাকা নিতে বাধ্য করা হয় তাদের।
জেলে মহাজনরা বলেন প্রতিটি নৌকার জন্য সরকারি ফি’র বাইরে ৫০০+৫০০ মিলে ১ হাজার টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়। অনুসন্ধানে সাংবাদিকদের হাতে আসা একাধিক কল রেকর্ডেও দালালদের মাধ্যমে ঘুষের টাকা নেওয়ার কথোপকথন পাওয়া গেছে। এতে অভিযোগকারীরা বলছেন, দুই কর্মকর্তা যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাদের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন স্বয়ং ডিএফ্ও।
সাতক্ষীরা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত চারটি স্টেশন- বুড়িগাওয়ালী, কদমতলা, কৈখালী ও কোবাতক। এর মধ্যে বুড়িগাওয়ালিনী স্টেশনকে সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেলেদের মতে এখান থেকেই পাস নবায়ন, নৌকা চলাচল ও মাছ-কাঁকড়া আহরণের সরকারি রাজস্বের বাইরে অতিরিক্ত কত টাকা নেওয়া হবে তা ‘একটি নির্দিষ্ট রেট’ হিসেবে ঠিক করে দেওয়া আছে। ফলে অন্যান্য তিন স্টেশনেও জেলেদের কাছ থেকে সরকারি ফি’র ৪০-৫০ গুণ পর্যন্ত বেশি টাকা দিতে হয়।
অথচ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের প্রজ্ঞাপনে সুন্দরবন এলাকায় মাছ ও কাঁকড়া আহরণের জন্য নির্ধারিত রাজস্ব হার নির্ধারণ করে দেয়। সেখানে উল্লেখ করা আছে- চিংড়ি প্রতি কুইন্টাল ৫০০ টাকা, কাঁকড়া প্রতি কুইন্টাল ৭৫০ টাকা, সাদা মাছ প্রতি কুইন্টাল ৬৪০ টাকা, রূপচাঁদা/ভেটকি/পাঙ্গাস প্রতি কুইন্টাল ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং নৌকা থেকে মাছ ধরার জন্য জনপ্রতি ১৫ টাকা সরকারি রাজস্ব খাতে জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু জেলেরা জানান, বাস্তবে পাস সই করার সময় কাঁকড়ার পাসে মাথাপিছু ৩৯০ টাকা, চরপাটা পাসে ৩৯০ টাকা আর ফাঁস জালের পাসে মাথাপিছু ৮০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়-যা সরকারি নির্ধারিত ফি থেকে বহুগুণ বেশি।
এদিকে ২০১৯ সালে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় কাঁকড়া পরিবহনের অনুমতি না পেয়ে জাহান আলী গাজীসহ আটজন নৌকা মালিক হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট একটি রায়ে নির্দেশনা দেয়- নৌকা সুন্দরবনে প্রবেশের আগে দিনের বেলায় কঠোরভাবে তল্লাশি চালাতে হবে। চারু, বিষ বা কোনো বেআইনি সরঞ্জাম যেন নৌকায় না থাকে। প্রতিটি নৌকাকে করণীয় ও দণ্ডনীয় বিষয়ক হ্যান্ডবিল/পোস্টার সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু অভিযোগকারীরা বলছেন, এসব নির্দেশনা উপেক্ষা করে স্টেশনে ‘স্বেচ্ছাচারী ও অতিরিক্ত অর্থ আদায়’ দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। যার সাথে জড়িত আছে ডিএফও। হাবিবুল ইসলাম এবং জিয়াউর রহমান ডিএফও হাসানুর রহমানের কাছের লোক পরিচয় দিয়ে দম্ভোক্তি করে থাকেন জেলেদের সাথে। ফলে জেলেরা অতিরিক্ত টাকা দিতে বাধ্য থাকেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন- আমাদের অফিসে আসেন। আমরা রাজস্ব ছাড়া টাকা নিই না। আমার স্টেশন থেকে সরকার নির্ধারিত ফি (রাজস্ব) ছাড়া অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করা হয়না। আমরা রিসিট ছাড়া টাকা নেই না।
অপর অভিযুক্ত রেঞ্জ সহকারী এ.বি.এম হাবিবুল ইসলামের মোবাইলে কয়েকবার কল দিলেও তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে খুলনা বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) হাসানুর রহমান সাথে কথা হলে এক প্রশ্নের জবাবে রাগান্বিত স্বরে তিনি বলেন- যেহেতু আমি জড়িত এমন কথা বলছেন তাহলে উপদেষ্টাকে ট্যাগ করেন। বক্তব্য ভাইরাল করে দেন। আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষকের দপ্তরের কর্মকর্তা (সিএফ) ইমরান আহমেদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ম্যাসেজ করার পরে তিনি কোন জবাব দেন নি। তবে এ অফিসের একজন কর্তা জানান- স্যারের কাছে ম্যাসেজ করে রাখেন কাজ হবে।
জেলে মহাজনরা বলেন- সরকারি নিয়ম মানতে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু অতিরিক্ত ঘুষ ছাড়া সুন্দরবনে প্রবেশ করা যায় না। পাস নেওয়া থেকে শুরু করে মাছ-কাঁকড়া উত্তোলন-সব জায়গায় অবৈধ ঘুষের টাকা দিতে হয়। এই সব দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বর্তমান সরকার ভেতরে- বাইরে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
স্থানীয় জেলে-মহাজন, মানবাধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদীরা এঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন। তাদের অভিযোগ, সুন্দরবনে দীর্ঘদিন ধরে ‘সাংগঠনিকভাবে ঘুষ বাণিজ্য’ চলছে, যার ফলে প্রকৃত জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেখানে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এই ঘুষবানিজ্যের সাথে জড়িত এবং আদায়কারী স্টেশন কর্মকর্তাদের মদদদাতা সেখানে জেলেদের কান্না শুনবে কে? ঘুষের সাথে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা সময়ের দাবী।

