কৃষিতালাসদরসাতক্ষীরা জেলাসারাবাংলা

জলাবদ্ধ এলাকায় পানির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠার অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্রি ধান–১০৩

বিশেষ প্রতিনিধি: তালা অঞ্চলের আড়ংপাড়া কৃষক আমিনুল ইসলাম চোখে মুখে সফলতার হাসি। খুশীতে টগবগ এ চাষী বললেন এবার সাতক্ষীরায় বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। জেলার অর্ধেকেরও বেশি ভূমি দীর্ঘ সময় ছিল জলাবদ্ধতার নিচে। হুমকির মুখে পড়ে আমন মৌসুমের ধান। কৃষকের দিনমজুরির ঘাম-ঝরানো মাঠ যখন পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে—তখনই আশীর্বাদ হয়ে আসে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবিত ধান জাত ব্রি ধান–১০৩। পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা এই জাত কৃষকের কাছে বিপদের বন্ধুত্বের মতো দাঁড়িয়েছে।

ধান চাষে নতুন আশা জাগিয়েছে ব্রি ধান-১০৩। জলাবদ্ধ এলাকায় পানির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে এই নতুন জাত দ্রুতই কৃষকদের আলোচনায় এসেছে। বর্ষায় ঘরছাড়া জমি যখন দীর্ঘদিন পানির নিচে ডুবে থাকে, ঠিক তখনই মাথা উঁচু করে টিকে থাকে ব্রি ধান-১০৩—ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে জন্ম নিচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। মাঠে গাছের শক্ত কাণ্ড আর পানির ওপর টিকে থাকা সবুজ শীষ যেন বদলে দিচ্ছে উপকূলের ধানের গল্প।

ব্রি খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয় ও ব্রি সাতক্ষীরার ইনচার্জ মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাজ্জাদুর রহমান জানান, “দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছে ব্রি–১০৩। কারণ এটি চিকন ধানের জাত, আর এ অঞ্চলে বিচলীর চাহিদাই বেশি। সেই কাঙ্ক্ষিত মান এ জাত থেকেই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়।” তিনি বলেন, সাতক্ষীরার জলাবদ্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের কৃষকরা এ জাতের ফলনে চরম সন্তুষ্ট। এমনকি যশোর ও খুলনার কৃষকরাও একই অভিজ্ঞতা জানিয়ে এখন নিজেরাই বীজ সংরক্ষণ করছেন। এ জাতটির গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ৬.২ টন, আর পরিচর্যা ভালো হলে ৭.৯৮ টন পর্যন্ত উৎপাদন সম্ভব। ধানের দানা লম্বা ও চিকন; চাল বাজারমূল্য বেশি এবং রফতানিযোগ্য। ১০০০ দানার ওজন প্রায় ২৩.৭ গ্রাম। এতে প্রোটিনের পরিমাণ ৮.৩ শতাংশ এবং অ্যামাইলোজ ২৪ শতাংশ। গড় জীবনকাল মাত্র ১৩০ দিন, ফলে ১ ফসলী জমিকে ২ ফসলী এবং ২ ফসলী জমিকে ৩ ফসলী জমিতে রূপান্তরিত করা যায়। বৃষ্টি–ভিত্তিক রোপা আমন চাষের জন্য এটি সবচেয়ে উপযোগী। বীজ বপনের সময় ১৫ জুন থেকে ৭ জুলাই। সারের মাত্রাও অন্যান্য উফশী জাতের মতোই। সবচেয়ে বড় সুবিধা—এই জাতের রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ তুলনামূলক কম। ফলে উৎপাদন খরচও কমে যায়।

ব্রি এলটিএসডি প্রকল্পের পরিচালক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, “নতুন ৬টি আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক ধানের গবেষণা জোরদার করা হয়েছে। যশোর–সাতক্ষীরা–খুলনা অঞ্চলের কৃষকদের মাঠে নতুন উদ্ভাবিত জাত সম্পর্কে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে। এর মধ্যে ব্রি–১০৩ এখন ‘আকাশচুম্বী’ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।”এ জাতটি এখন বিভিন্ন জেলা–উপজেলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কৃষক নিজেরাই বীজ সংরক্ষণ করছেন এবং প্রতিবছর নতুন কৃষকদের মাঝে বিতরণ করছেন। গবেষক ও কৃষিবিভাগ বলছে—ব্রি ধান–১০৩ শুধু একটি নতুন ধানের জাত নয়; এটি জলবদ্ধ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তার নতুন ভরসা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ রফিকুল ইসলাম জানান, “দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে সবচেয়ে ভালো মানিয়ে নিতে পারে ব্রি ধান। তাই কৃষকদের শুধু চাষ নয়—নিজস্ব বীজ সংরক্ষণেও উৎসাহ দিচ্ছে বিভাগ।”

ব্রি’র আয়োজনে রবিবার সন্ন্যাসগাছাতে অনুষ্ঠিত হয়, ব্রি ১০৩ জাতের ধানের ফসল কর্তন উৎসব ও মাঠ দিবস। যেখানে শত শত কৃষক কৃষাণী ব্রি ১০৩ জাতের ধানের ফসল কর্তন করেনি করেছে উৎসব। সেখানে কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি কর্মকর্তাদের কাছে চাষীরা তাদের সব মনের অভিব্যাক্তি প্রকাশ করেন সেখানে। সেখানে সফলতার কথা যেমন উল্লেখ করেন তেমন সেখানে তাদের চাষাবাদে সকল সমস্যার কথা উল্লেখ করেন।

বিশেষজ্ঞদের বরাতে কৃষিবিদ রফিকুল বলেন, আধুনিক কৃষি গবেষণা বাংলাদেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে। এরই ধারাবাহিকতায় জন্ম হয়েছে ব্রি ধান–১০৩—যেখানে ব্রীডিং প্রযুক্তি, আঞ্চলিক আবহাওয়া, মাটি, পানির উচ্চতা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সমন্বয় করা হয়েছে। ব্রি ধান–১০৩ এর উৎস ‘বিআর (বিআইও) ৮৯৬১-এসি-২৬-১৬’। শুরুতে ব্রি ধান–২৯ এর সঙ্গে এফএল–৩৭৮ এর সংকরায়ণ করা হয়। পরে অ্যান্থার কালচার (জীবপ্রযুক্তি) পদ্ধতিতে হোমোজাইগাস গাছ তৈরি করা হয়। তিন বছর গবেষণাগারে ফলন পরীক্ষা শেষে কৃষকের মাঠে আমন ২০১৮ মৌসুমে এর পরীক্ষামূলক চাষ হয়। ২০১৮–২০২১ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক মাঠপর্যায়ের পরীক্ষায় দেখা যায়—এ জাতটির ফলন ব্রি–৪৯ ও ব্রি–৮৭ এর চেয়ে বেশি। সব পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার পর ২০২২ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রি ধান–১০৩ জাতটিকে অনুমোদন দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *