অপরাধআশাশুনিকালিগঞ্জরাজনীতিসাতক্ষীরা জেলা

সাতক্ষীরা-৩: বিএনপির গ্রুপিং দাবানলে পুড়ছে ধান, ওজনের পাল্লায় একাট্টা জামায়াত

স্টাফ রিপোর্টার: সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি-কালিগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে শুরু হয়েছে অঘোষিত ‘দ্বন্দ্বযুদ্ধ’। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মো. আলাউদ্দিনকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে সম্ভাব্য তালিকায় রাখার পর থেকেই এ আসনে দেখা দিয়েছে তীব্র বিভাজন।

গত ১০ দিন যাবৎ আশাশুনি ও কালিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ডাঃ শহিদুল আলমের সমর্থকরা বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশ ও কাজী আলাউদ্দিনের কুশপুত্তলিকা দাহসহ নানা কর্মসূচি পালন করে চলেছেন। তাদের মূল দাবি- কাজী আলাউদ্দিনের মনোনয়ন বাতিল করে শহিদুল আলমকে ধানের শীষে প্রার্থী ঘোষণা করতে হবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা নলতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান, বিষ্ণুপুর ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম, জেলা বিএনপির সদস্য নুরুজ্জামান, উপজেলা জাসাসের সাবেক নেতা এসএম বাবু, উপজেলা কৃষকদলের সাবেক সভাপতি শেখ রবিউল ইসলাম, উপজেলা বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক খায়রুল আলম। এই ক’জনের বাইরে ডাঃ শহীদুল আলমের পক্ষে দুই উপজেলা থেকে আর কোন নেতা নেই।

এই ক’জনের নেতৃত্বেই ডাঃ শহীদুল আলমের পক্ষে একেক দিন ভিন্ন আঙ্গিকে আন্দোলন, সংগ্রাম-বিক্ষোভ ও অর্থায়ন হচ্ছে। এমনকি প্রতিদিন আন্দোলনে ব্যয় হচ্ছে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত- যার পুরো খরচ বহন করছেন চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান।

জেলার রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আন্দোলনের পেছনে শুধু মনোনয়ন বঞ্চনার ক্ষোভ নয়, খলিশাখালীর ভূমিহীন জনপদের ‘ভূ- রাজনীতিতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা’ও যুক্ত আছে। অভিযোগ রয়েছে, যিনি বিএনপি দলীয় কোন পদে না থেকেও নলতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান খলিশাখালী এলাকার ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে মাথাপিছু টাকা দিয়ে ট্রাকে করে এনে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করাচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, শহিদুল আলম প্রার্থী হলে এই জনপদ আজিজুর রহমানের দখলে থাকবে। যেমনটি ছিল বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মনোনয়ন বিবেচনার আগে ডাঃ শহিদুল আলমের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের তথ্য উঠে আসে। এসব কারণেই তিনি মনোনয়ন তালিকায় স্থান পাননি। তবে তার জনপ্রিয়তা ও মানবিক কার্যক্রম স্বীকার করছেন সবাই। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি বিনা খরচে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ বিতরণ করেছেন, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

তথ্যানুসারে, দুই উপজেলার মোট ২৪টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র দুটি ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা শহিদুল আলমের পক্ষে বিক্ষোভ করছে। বাকি ২২টি ইউনিয়নের বিএনপি নেতা-কর্মীরা কাজী আলাউদ্দিনের পক্ষে রয়েছেন। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের অধিকাংশ সাংগঠনিক নেতা কাজীর নেতৃত্বেই মাঠে কাজ করছেন।

এদিকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগে গত ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে ডাঃ শহিদুল আলমের সমর্থকদের একটি গ্রুপ থেকে তিনটি পিকআপ, প্রচুর ইট-পাটকেল, বাঁশের লাঠি, গুলতি ও নাশকতা সামগ্রীসহ চারজনকে আটক করে। এই ঘটনার পর উত্তেজনা আরও বাড়ে।

তবে, ডাঃ শহীদুল আলমের পক্ষের প্রতিবাদ মিছিল থেকে ‘ভণ্ড কাজী, দালাল কাজী, ভুয়া কাজী’- এমন সব উস্কানিমূলক স্লোগান ও কুশপুত্তলিকা দাহে এলাকা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।

কালিগঞ্জের এক প্রবীণ রাজনীতিবিদ বলেন, ডাক্তার শহিদুল আলমের পক্ষে এখন দুটি ইউনিয়নের লোক আন্দোলন করছে। কিন্তু যদি তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়, তখন ২২ ইউনিয়নের মানুষই কাজী আলাউদ্দিনের পক্ষে রাস্তায় নামবে- তখন সামলানো কঠিন হবে।

কালিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহবায়ক চেয়ারম্যান এবাদুল ইসলাম জানান- কাজী আলাউদ্দিন সাহেব ভালো লোক। কেন্দ্র তাকে নমিনেশন দিয়েছে। আমরা তার পক্ষেই কাজ করছি। যারা আন্দোলন করছে তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই করছে।

আশাশুনিয় উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দস বলেন- কতিপয় ব্যক্তি ডাঃ শহিদুল আলমের পক্ষে আন্দোলন করছে। তারা দলের পদবীধারী না।

বিএনপির এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে জামায়াত। স্থানীয় সূত্র জানায়, বিএনপির বিভাজনকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে জামায়াতের কর্মীরা প্রতিদিন ভোর থেকে গ্রামে গ্রামে পথসভা করছে, তৃণমূল সংগঠন পুনর্গঠনের কাজও ত্বরান্বিত করছে। তারা ‘বিএনপির বিভাজনে গোল’ দিয়ে নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছে।

আশাশুনির ব্যবসায়ী মো. সালাউদ্দিন বলেন, নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে শেষ পর্যন্ত ক্ষতি হবে দলেরই।

সবমিলিয়ে সাতক্ষীরা-৩ আসনে এখন বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষে কাজী আলাউদ্দিন, অন্যপক্ষে ডাঃ শহিদুল আলম। টানা বিক্ষোভ, উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগে এলাকায় অস্থিরতা বিরাজ করছে।

জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বন্দ্ব মেটানো ছাড়া এখন বিএনপির সামনে কোনো বিকল্প পথ নেই। আগে ঐক্য ফিরিয়ে না আনলে, নির্বাচনে শূন্য ফলাফল হাতে ফিরতে হবে।

অন্যদিকে, যখন ধানের শীষে বিভাজনের দাবানল জ্বলছে, তখন দাঁড়িপাল্লার ওজনে জামায়াত একাট্টা ও সংগঠিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *