অনলাইনঅপরাধআইন আদালতকালিগঞ্জসাতক্ষীরা জেলা

কালিগঞ্জের চম্পাফুলে গাছ গাছালি কেটে রাস্তা বন্ধ করে, ঘর বানিয়ে, ঘেরা দিয়ে জমি দখলের চেষ্টা

স্টাফ রিপোর্টার: কালিগঞ্জ উপজেলার চম্পাফুল কালীবাড়ি বাজারে কমপক্ষে ১০ প্রজাতির শতাধিক গাছ গাছালি কেটে, ফল লুট করে, চলাচলের প্রধান রাস্তা বন্ধ করে ঘরের চাল ও বেড়া বানিয়েএক হিন্দু পরিবারের চার বিঘা জমি জবরদখলের চেষ্টা করা হয়েছে। রবিবার ভোর থেকে সোমবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত এ জবরদখলের কাজ চলে। রবিবার ভোর ৫টা থেকে এ জবরদখল প্রক্রিয়া শুরু হলে থানায় অভিযোগ করলেও পুলিশ আসে সোমবার সকাল সোয়া ১১টায়। পুলিশের উপস্থিতিতে জবরদখল ও লুটপাট চালানো অব্যহত রাখার ছবি মোবাইলে ধারণ করায় উপপরিদর্শক সাব্বির আহম্মেদ ক্ষতিগ্রস্ত শংকর মন্ডলের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সংগৃহীত দুই দিনের ভিডিও ডিলেট করে দেন।

কালিগঞ্জের চম্পাফুল গ্রামের সুনীল কুমার মন্ডল জানান, জ্ঞানেন্দ্র মন্ডলের ওয়ারেশ সূত্রে চম্পাফুল মৌজার ৮৮ দাগে তিন বিঘা ও হাজারী মন্ডলের কাছ থেকে ক্রয় সূত্রে ৯১ দাগে নিজের ও স্ত্রী মাধবী মন্ডলের কাছ থেকে ৪১ শতক জমি কিনে তাতে ফলজ ও বনজ গাছ গাছালি লাগিয়ে , পুকুরে মাছ চাষ করে ১৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা শান্তিপূর্ণ ভোগদখলে রয়েছেন।

ওই জমির কিছু অংশ অর্পিত সম্পত্তি হওয়ায় তিনি আদালতে মামলা করেন। জাল জালিয়াতির মাধমে কাগজপত্র তৈরি করে ওই জমি নিজের দাবি করে মামলায় বাদি শ্রেণীভুক্ত হন তাদের শরীক ধীরেন্দ্রনাথ মন্ডলের ছেলে কমল মন্ডল। মামলায় সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টেও জিতে যান তিনি (সুনীল)। রায় ও ডিক্রী সুনীলের পক্ষে যায়।একপর্যায়ে ১৬ শতক জমি কমল অনিয়মের মাধ্যমে আলমগীরের নামে লিখে দেয়। আদালতে কমল ওই জমির স্বত্বহীন হলে কৌশলে ওই জমি তার ছেলে তাপস মন্ডলের নামে লিখে দেয়। তাপস মন্ডলের কাছ থেকে ওই জমি জালজালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে লিখে নেয় আওয়ামী লীগ কর্মী একই গ্রামের বেলায়েত হোসেনের ছেলে সামাদ গাজী ও আলমগীর।

একপর্যায়ে সামাদ গাজী ১৯৮০ সালের একটি জাল দলিলমূলে ওই জমির একাংশ ২০১২ সালে জবরদখল করে সেখানে রাইস মিল বানায়। বাধা দেওয়ায় তাকে ও তার স্ত্রী মাধবী ও ছেলে শংকর মন্ডলকে মারপিট করে।

এ ছাড়া দুই দফায় শংকরকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে রাম দা, ছুরি, লাঠি ও প্রেটোলের বোতলসহ ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে রাতভর নির্যাতন চালানো হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা করা হলেও বিচার পাননি তারা।

সুনীল মন্ডল আরো জানান, বেআইনিভাবে তাপস ম-লের কাছ থেকে জমি নিয়েছেন দাবি করে হেরে যাওয়ায় সামাদ গাজীর মিল উচ্ছেদ করতে তিনি কালিগঞ্জ সহকারি জজ আদালতে দেঃ ৪৮৮ নং মামলা করেন। যার ধার্য দিন আগামি ২৪ আগষ্ট। এ ছাড়াও সামাদ গাজীর বিরুদ্ধে একই আদালতে দেওয়ানী ৩১৪ নং মামলা চলমান রয়েছে। তার শেষ সাক্ষীর জ্য দিন রয়েছে আগামি ৫ সেপ্টেম্বর। বর্তমানে তিনি, তার স্ত্রী মাধবী, ছেলে শংকর, পুত্রবধু সরস্বতী মন্ডল, মেয়ে চম্পা ম-ল নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।

সুনীল মন্ডল বলেন, আগামি ধার্য তারিখে তার মিল উচ্ছেদ করার আদেশ হতে পারে এমন আশঙ্কায় সামাদ গাজী ও আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে ৫০/৬০ জন ভাড়াটিয়া সশস্ত্র সন্ত্রাসী (যাদের অধিকাংশের বাড়ি আশাশুািনর গোদাড়ায়)। রবিবার ভোর ৫টার দিকে তাদের জমির মধ্যে ঢুকে আম, কাঁঠাল, কলা, জাম, জামরুলসহ কমপক্ষে ১০ প্রজাতির ফলজ ও বণজ বৃক্ষ কেটে সাবাড় করে ও ফল লুট করে। বাড়িতে ঢোকার প্রধান রাস্তা বাঁশের চটা দিয়ে ঘেরার সময় বাধা দেওয়ায় ও গাছ কাটার দৃশ্য ভিডিও করতে যাওয়ায় তাদেরকে দা ও লোহার রড দিয়ে হত্যার চেষ্টা করলে তারা ঘরের ভিতরে আশ্রয় নেন।

বিষয়টি তাৎক্ষণিক কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করলে ও রোরবার বিকেলে থানায় লিখিত অভিযোগ করলেও পুলিশ আসেনি। সোমবার সকাল থেকে জবরদখলকারিরা আবারো চারবিঘা জমির চারিপাশে ঘেরা দেওয়া শুরু ও একটি ঘরের জন্য সিমেন্টের পিলার বসানো শুরু করলে বারবার থানাকে অবহিত করেন। সকাল ৯টার দিকে দুইজন সাংবাদিক ঘটনাস্থলে এলে জবরদখলকারিরা তাদের লক্ষ্য করে হামলা চালাতে যায়। একপর্যায়ে সোয়া ১১ টার দিকে উপপরিদর্শক সাব্বির আহম্মেদ এর নেতৃত্বে চারজন পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। পুলিশের উপস্থিতিত ঘর নির্মাণ ও জবরদখলের কাজ করার ছবি ভিডিও করতে গেলে উপপরিদর্শক সাব্বির হোসেন ছেলে শংকর ম-লকে মারতে যান। এমনকি দুই দিন ধরে মোবাইলে থাকা সকল ভিডিও ডিলেট করে দেন তিনি। পুলিশ চলে যাওয়ার সাথে সাথে সামাদ গাজীর লোকজন আবারো টিন দিয়ে ঘরের চাল তৈরি শুরু করে। উপপরিদর্শক সাব্বির আহম্মেদ সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় দুপক্ষকে নিয়ে বসাবসির জন্য তাকে (সুনীল) থানায় যেতে বলেন। ওই সময় তাদের জন্য নিরাপদ নয় বলায় উপপরিদর্শক সাব্বির আহম্মেদ তার উপর ক্ষুব্ধ হন। এমনকি বিষয়টি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানকে জানালে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন রাতে না এলে পরদিন সামাদ গাজী কোন অঘটন ঘটালে তার কিছু করার থাকবে না।

প্রত্যক্ষদর্শী একই গ্রামের আব্দুস সবুর, রফিকুল ইসলাম, ইউপি সদস্য ইব্রাহীম হোসেন, মাষ্টার সাধুরঞ্জন খাঁসহ কয়েকজন বলেন, যেভাবে ফিল্মি স্টাইলে জমি জবরদখল করা হচ্ছে তাতে ওই পরিবারটি রাতের আঁধারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান তারা।

চম্পাফুল গ্রামের গফুর গাজীর ছেলে রেজাউল করিম বলেন, তার সতাতো চাচা সামাদ গাজী, আব্দুর রউফ ও বরকতুল্লা গাজীসহ কয়েকজন জমিস নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে ১৯৮৯ সালের ২৯ জুলাই বালাপোতায় তার দুই ভাই মফিজুল ও আরিফুলকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় তার বাবা গফুর গাজী বাদি হয়ে সামাদ গাজীসহ নয় জনের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা করেন। একইভাবে ওই জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে সামাদ গাজী ও তার সহোদররা ১৯৯০ সালের ২৩ মে বালাপোতায় ভাই শফিকুল ও তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করলে শফিকুল মারা যায়। তিনি মারাত্মক জখম হলেও জীবনে বেঁচে যান।

এ ঘটনায় তিনি সামাদ গাজীসহ ১২ জনের নামে মামলা করেন। ভয়ে তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর পালিয়ে ঢাকায় ছিলেন। আব্বা মারা যাওয়ার পর তিনি ২০২১ সালে বাড়িতে এলেও অধিকাংশ সময় বাড়িতে থাকতে পারেন না। একপর্যায়ে তারা দুটি হত্যা মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন। একই ভাবে হিন্দ্রু ব্রাহ্মন সম্প্রদায়ের এক পুরোহিত বলেন, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর তার স্ত্রীকে ঘরের মধ্যে ঢুকে ধর্ষণ করে সামাদ গাজী। এ ঘটনায় মামলা হলেও তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। খুন হওয়ার ভয়ে মামলা চালাতে পারেননি তিনি।

এ ব্যাপারে সামাদ গাজীর কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি থানার ভিতরে রয়েছেন। পরে কথা বলবেন।

কালিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক সাব্বীর আহম্মেদ বলেন, তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর শংকল মন্ডল ভিডিও করায় তার কাছ থেকে মোবাইল সেট নিয়ে ফুটেজ ডিলেট করে দেওয়া হয়েছে।

কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানান, রবিবার কোন জবরদখলের ঘটনা ঘটেনি। সোমবার খবর পেয়ে পুলিশ পাঠানো হয়। এখনো জবরদখলের কাজ চলছে জানানো হলে তিনি বলেন, সুনীল মন্ডলকে আদালতে যেতে বলুন। দু’পক্ষকে নিয়ে সােমবার সন্ধ্যায় থানায় বসার জন্য বলা হয়েছে। সুনীল মন্ডল পরিবারের জন্য সন্ধ্যার পর বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয় জানালে তিনি বলেন, এতে তার কিছু করার নেই।

সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম জানান, বিষয়টি রবিবার রাতে জানার পর কালিগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *