সুন্দরবনের বুনো ফল কেওড়া- জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সংযোগ
সুন্দরবন থেকে ফিরে তাপস কুমার ঘোষ, কালিগঞ্জ: সুন্দরবনের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদ-নদী আর বিস্তীর্ণ চরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কেওড়া গাছ যেন উপকূলবাসীর জীবনে নীরব আশীর্বাদ। এই গাছের ফল ‘কেওড়া’—স্থানীয়ভাবে বুনো ফল হিসেবে পরিচিত হলেও বহু বছর ধরে এটি উপকূলীয় মানুষের খাদ্য, ওষুধ ও জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সাধারণত বর্ষা মৌসুমে কেওড়া গাছে ফল ধরে এবং আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে তা সংগ্রহ করা হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ থেকে বছরে গড়ে ৪০–৫০ কেজি ফল মেলে। বাজারে প্রতি কেজি ২০–৩০ টাকায় বিক্রি হওয়ায় এটি অনেক দরিদ্র পরিবারের জন্য অতিরিক্ত আয়ের উৎস। ইতোমধ্যে এনজিওগুলোর সহায়তায় স্থানীয়রা ফল প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করেছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করছে।
কাঁচা কেওড়া খাওয়া যায় না। তবে সিদ্ধ, আচার বা চাটনি হিসেবে এটি সুস্বাদু। ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ এই ফল দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, হজমজনিত সমস্যা ও জ্বরের ঘরোয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও কেওড়ার উল্লেখ রয়েছে।
বৈজ্ঞানিক নাম: Pandanus odorifer. প্রাচীনকাল থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে বুনোভাবে জন্মানো কেওড়া মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। কেওড়ার পাতা দিয়ে একসময় ঘরের ছাউনি, দড়ি ও মাদুর তৈরি হতো। ফল ছিল মানুষ, মাছ ও বন্যপ্রাণীর অন্যতম খাদ্য।
কেওড়ার ফুল থেকে মৌমাছি সুগন্ধি ও ঔষধি গুণসম্পন্ন মধু সংগ্রহ করে। শত শত বছর ধরে সুন্দরবনের মৌয়ালরা এই মধুর ওপর নির্ভরশীল।
কেওড়া দিয়ে তৈরি আচার ও চাটনি দেশের বাজারে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি বিদেশেও রপ্তানি শুরু হয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।
কেওড়া শুধু অর্থনৈতিক নয়, পরিবেশগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি নদীভাঙন ও জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে প্রাকৃতিক বাঁধ হিসেবে কাজ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায়ও কেওড়া কার্যকর প্রাকৃতিক সম্পদ।
বানর: বর্ষা-শরতে দলবদ্ধভাবে কেওড়া ফল খায়। হরিণ: পাতা ও পাকা ফল তাদের অন্যতম খাদ্য। মাছ: পানিতে ঝরে পড়া ফল মাছের খাদ্য হিসেবে কাজ করে এবং প্রজননে সহায়তা করে।
পরিবেশবিদদের মতে, অবৈধভাবে গাছ কাটা ও বন ধ্বংস কেওড়ার বিস্তারে বড় হুমকি। বন বিভাগ স্থানীয়দের সচেতন করছে যাতে নিয়ন্ত্রিতভাবে ফল সংগ্রহ হয় এবং গাছ সংরক্ষিত থাকে। ইতোমধ্যে সামাজিক বনায়নের অংশ হিসেবে নদীর তীরে কেওড়া লাগিয়ে ভাঙনরোধ ও জীবিকা অর্জন করছে অনেক মানুষ।
সুন্দরবনের বুনো ফল কেওড়া শুধু খাদ্য বা আয়ের উৎস নয়, বরং প্রাণীকুলের টিকে থাকার অন্যতম ভরসা। তাই কেওড়া সংরক্ষণ মানে শুধু বন রক্ষা নয়, বরং পুরো জীববৈচিত্র্যের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।