বৃষ্টিস্নাত সাতক্ষীরায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের উত্তাপে সিক্ত শিল্পীরা
স্টাফ রিপোর্টার: শ্রাবণের বর্ষণে শুধু ভেজাচ্ছে না বর্ষাধারায় গোটা সাতক্ষীরাকে করছে জলাবদ্ধ। সেই আবদ্ধ মানুষের মননের মুক্তিতে উত্তাপ ছড়ালো রবীন্দ্রসঙ্গীত। বিশ^কবির সোনার বাংলার দক্ষিণের জনপদের বাঘ কুমির আর অন্ধকার কুপমুন্ডকতার সাথে হার না মানা সাংস্কৃতিক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়া সেসব শিশুকিশোরসহ সাধারণ শিল্পীদের জন্য অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষণ কর্মশালা ১৪৩২ অনুষ্ঠিত হলো সাড়ম্বরে। সঙ্গীত প্রশিক্ষণের বিশ^স্ত সুহৃদজন বাদল দাসের ভালবাসা আর হাতে মুখের শিক্ষায় আলোকিত পথ খুঁজে নিলো প্রশিক্ষনার্থীরা।
১৩ শ্রাবণ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত গবেষক ও কর্মশালার আয়োজক সংগঠন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ্ সাতক্ষীরার এ আয়োজনে প্রশিক্ষক ছিলেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য বাদল দাশ।
উদ্বোধনী ও সমাপনি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সাতক্ষীরার আহবায়ক শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন।
শিশু কিশোর শিল্পীদের মাঝে আলোচনা করেন পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো: সালাহউদ্দিন, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাতক্ষীরা আঞ্চলিক শাখার ইনচার্জ ড. শিল্পী দাস, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার, কালচারাল অফিসার ফাইজা হোসেন অন্বেষা, সংগঠনের পাটকেলঘাটা শাখার সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল হামিদ, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সাংবাদিক আমিনা বিলকিস ময়না, অধ্যাপক শেখ হেদায়েতুল ইসলাম, সাতক্ষীরা শাখার সঙ্গীত শিক্ষক আতিকুর রহমান জাকু, নয়ন ভট্টাচার্য্য, প্রাবন্ধিক মনিরুজ্জামান, মিঠুন দেবনাথ, প্রতাপ কুমার সরদার, প্রিন্স রায় চৌধুরী প্রমুখ।
প্রশিক্ষক বাদল দাশ বলেন, রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর জীবনের বোধের সুস্পষ্ট মুখ। যার আলোকিত বাঙালীর সভ্যতা কৃষ্টি আর সংস্কৃতি। তার সঙ্গীতের পরতে পরতে শিক্ষা আরো জীবনের মূল্যবোধ। তাই তার সঙ্গীতকে ধারণ করতে হয় হৃদয় থেকে। ক্রান্তিকালের অন্ধকার সরাবার মন্ত্রমুগ্ধ পথের দিশা হলো রবীন্দ্র চিন্তা। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে ও প্রকাশে থাকতে হয় সতর্ক এবং অফুরাণ দরদ। দরদী কন্ঠের থেকে দরদীবোধ মানবিকতায় বেশী প্রয়োগ থাকা তাই সময়ের দাবি।
প্রকৌশলী মো: সালাহউদ্দিন বলেন, শ্রাবণের একটানা বর্ষণে যখন গোটা সাতক্ষীরা যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ে—। নগরের অলিগলি থেকে গ্রামীণ জনপথ হয়ে ওঠে জলাবদ্ধ ও জীর্ণ, তখন সেই মন্থর প্রেক্ষাপটে ভিন্ন এক প্রাণের উচ্ছ্বাস নিয়ে হাজির হলো রবীন্দ্রসঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুর ও বাণীর উত্তাপে সেদিন সিক্ত হলো শতাধিক রবীন্দ্রপ্রেমী। কেবল গানের অনুশীলন নয় এই আয়োজন হয়ে উঠলো যেন এক আত্মার জার্নি, হৃদয়ের আহ্বান, এক মানবিক চেতনার সন্ধান।
কালচারাল অফিসার ফাইজা হোসেন অন্বেষা বলেন, গানের ভেতর দিয়ে এক বৈচিত্র্যভরা ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিলেন তরুণ, কিশোর, প্রবীণ সব বয়সের অংশগ্রহণকারীরা। কেউ কেউ প্রথমবার মঞ্চে গান শেখার সুযোগ পেলেন, আবার কেউ নিখুঁততা ও আবেগ প্রকাশে পথের দিশা খুঁজে পেলেন।
কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট প্রশিক্ষক বাদল দাশ। তার সুগভীর সঙ্গীতচর্চা ও আন্তরিক শিক্ষাদানে মুগ্ধ হয় অংশগ্রহণকারীরা। গানের ভঙ্গি, উচ্চারণ, লয়, ভাবপ্রকাশ, সুরের সৌন্দর্য এবং রবীন্দ্রভাবনার গভীরতা বিষয়ে তিনি দেন পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা।
সাতক্ষীরা জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার বলেন, “রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি বা সুরস্রষ্টা নন, তিনি বাঙালির মননের এক জীবন্ত ভাষা। তার সৃষ্টির ভেতর দিয়ে আমরা মানুষ হতে শিখি। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হলে চাই হৃদয়ের প্রস্তুতি। কণ্ঠের চেয়ে বড় হলো অনুভব, নিখুঁত গলার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মানবিক দরদ।”
সভাপতির বক্তব্যে শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন বলেন, “এই আয়োজন কেবল গান শেখানোর জন্য নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার অংশ। আমরা চাই, শিশু-কিশোরসহ সববয়সীরা রবীন্দ্রনাথের গানকে আস্থা করুক নিজের জীবনে রবীন্দ্রভাবনাকে কাজে লাগাক।”
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী ও অতিথিদের মধ্যে ছিলেন সাতক্ষীরার বিভিন্ন পর্যায়ের সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বরা।
এই প্রশিক্ষণ কর্মশালার অন্যতম আকর্ষণ ছিল শিশু-কিশোর শিল্পীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। তাদের মাঝে রবীন্দ্রভাবনা, সঙ্গীতচর্চা এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে এই আয়োজন। অনেকেই জানান, এমন একটি সুশৃঙ্খল ও আন্তরিক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠান সাতক্ষীরায় এই প্রথম বলে অভিহিত করেন অনেকে।
এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ ও পরমত সহিষ্ণুতা, মানবতা, সত্য ও সৌন্দর্যের প্রতি আবারও নিবিড়ভাবে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। আয়োজকদের পক্ষে অধ্যাপক শেখ হেদায়েতুল ইসলাম জানান, ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা নিয়মিতভাবে আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মৌমিতা বিশ^াস জানান, শ্রাবণের বর্ষণ যেমন প্রকৃতিকে শীতল করে, তেমনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বর্ষণমুখর দিনকে সাতক্ষীরার সাংস্কৃতিক আকাশকে করেছে উদ্দীপ্ত, উজ্জ্বল ও জাগ্রত।