অনলাইনআন্তর্জাতিকইতিহাস ঐতিহ্যসাতক্ষীরা জেলা

জিআই স্বীকৃতি পেলো সুন্দরবনের মধু

স্টাফ রিপোর্টার: পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও ভারত অংশ মিলে যার আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা নিয়ে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবন রয়েছে ৬ হাজার ১৭ কিলেমিটার, যা মোট আয়তনের ৬০ ভাগ।

বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে গড়ে প্রতিবছর মধু আহরণ হয় ৩০০ মেট্রিক টন। অন্যদিকে ভারতের গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী সে দেশে মধু উৎপাদন হয় ১৫৭ মেট্রিক টন। নানা গবেষণায় বাংলাদেশ অংশের মধুর গুণাগুণও বেশি বলে জানানো হয়েছে। সব বিবেচনায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বন উন্নয়ন করপোরেশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জিআই পণ্য হিসেবে মধুর আন্তর্জাতিক সনদ পেয়েছে তারা। তবে এবছর বাংলাদেশী মধুর জিআই পন্য হতে বাধা নেই আর। সব বাধা পেরিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশও এই স্বীকৃতি অর্জনে সফল হয়েছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে এই মধু ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি অর্জন করে, যা দেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

এই অর্জন যেমন গর্বের, তেমনি এর সঙ্গে জড়িত কিছু গভীর উদ্বেগও রয়েছে। মৌসুম শুরুর আগেই কিছু অসাধু জেলে ও বাওয়ালি অপরিপক্ব মধুর চাক কেটে নিচ্ছেন, যা মধুর গুণগত মান নষ্ট করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক প্রজনন চক্রও বাধাগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে, কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী কৃত্রিমভাবে চিনি জ্বালিয়ে মধু তৈরি করছেন এবং বাক্সে মৌমাছি রেখে বনের মধু বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এতে প্রকৃত মৌয়ালরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

২০২৪ সালে শুধু সাতক্ষীরা রেঞ্জেই ৩৬৪টি পাস এরর মাধ্যমে ১ হাজার ২৩৫ দশমিক ৫০ কুইন্টাল মধু ও ৩ শত ৭০ দশমিক ৬৫ কুইন্টাল মোম সংগ্রহ হয়, যা থেকে সরকার প্রায় ২৮ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করে। ২০২৫ সালের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়িয়ে ধরা হয়েছে মধুর ক্ষেত্রে ১ হাজার ৫ শত কুইন্টাল এবং মোমের ক্ষেত্রে ৪ শত কুইন্টাল।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বনাঞ্চলে ফুল ফোটার হার কমে যাওয়ায় মধু উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। মধু উৎপাদনের সঙ্গে ফুলের সরাসরি সম্পর্ক থাকায় এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আশার কথা হলো, বন বিভাগ ও স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিভিন্ন ফুলজাতীয় গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে মধু উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

বিশ্বের সবচেয়ে দামি প্রাকৃতিক মধু নিউজিল্যান্ডের ‘ভানুকা’ মধু, যার কেজিপ্রতি দাম ৫০-৬০ হাজার টাকা। সুন্দরবনের মধুও যদি উপযুক্তভাবে প্রক্রিয়াজাত ও মান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যায়, তবে এটি আন্তর্জাতিক বাজারে একই মর্যাদা লাভ করতে পারে।

সরকারিভাবে মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা স্থাপন, মান নির্ধারণ ও রপ্তানির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে এ খাত হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি বড় উৎস। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি হবে নতুন কর্মসংস্থান, যা জাতীয় অর্থনীতিকে আরও চাঙা করতে সহায়তা করবে।

সুন্দরবনের মধু শুধু বোতলজাত সুস্বাদু তরল নয়, এটি আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য, জীবিকাভিত্তিক সম্ভাবনা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আত্মনির্ভরতার প্রতীক। এই সম্পদ রক্ষা করা শুধু দায়িত্ব নয়, বরং এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি মূল্যবান সঞ্চয়ও বটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *