অনলাইনজীবনযাপনশ্যামনগরসাতক্ষীরা জেলাসারাবাংলা

‘উপকূলের আলো’ শ্যামনগরের ইউএনও রনী খাতুন

এম আব্দুর রহমান বাবু, শ্যামনগর: মাতৃত্ব ব্যতিরেকে অর্পিত সরকারী দায়িত্ব নিয়ে ছুটেচলা অদম্য এক নারী সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোছাঃ রনী খাতুন। উপকূলের আলো’ খ্যাত এই নারী রাতকে দিন করে সামলিয়ে চলেছেন দেশের সর্ববৃহৎ এবং বিপদসংকুল উপজেলা শ্যামনগরের মানুষকে। উপকূলবাসীর মুখে হাসি ফোটাতে এবং শ্যামনগরকে আদর্শ উপজেলা হিসেবে গড়তে বারবার উঠে আসছেন আলোচনায়।

ঘড়ির কাঁটা রাত ১টা ছুঁই ছুঁই। বাসায় ফিরে বেডরুমে ঢুকতেই নজর পড়ে সেদিকে। নেই খাওয়া- নেই দাওয়া। নিরন্তর ছুটে মা ছুটছেন অবিরত উপকূলে থাকা বিপদশংকুল মানুষের কাছে। এদিকে রাত জেগে অপেক্ষায় বসে থাকা পরিবারের সদস্যরা। বিশেষ করে দিনশেষে মায়ের অপেক্ষায় থাকা তিনটা ছোট বাচ্চা ঘুমে কাতর। সবচেয়ে ছোট্ট বাচ্চা তার মাত্র ১১ মাস বয়স। সে যেখানে মায়ের কোলে থাকবে, সেখানে মাকে না পেয়ে খাটের এককোণে আনমনে শুয়ে। এভাবেই ছুটে চলেন ইউএনও রনী খাতুন।

অন্ধকার পেরিয়ে আসা মা, আবছা আলোতে বাচ্চাদের নিষ্পাপ মুখগুলো দেখে নিজেকে অসহায় মনে হবে। কাছে যেতে না যেতেই চোখে পানি চলে আসবে যে কারো। মা কে কাছে না পাওয়ার আকুলতা- অসহায়ত্ব দেখলে স্তব্দ হয়ে আসবে অনেকের পৃথিবী। সবকিছু পাশ কাটিয়ে দায়িত্ব পালনে রনী খাতুন যেন ‘উপকূলের আলো’ হিসেবে আবির্ভূত।

কথা প্রসঙ্গে ইউএনও বলতে থাকেন- সবসময় ভাবি আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্ব পালনের তৌফিক দিয়েছেন হয়তো তার মধ্যেই আমার বাচ্চাদের ভালো নিহিত আছে। আল্লাহর কাছে এইটুকুই চাওয়া আমাদের উপকূলের মানুষের জান-মাল যেন আমি রক্ষা করতে পারেন- এমনি ভাবে বিষন্ন মনে কথাগুলো বলছিলেন শ্যামনগর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনী খাতুন।

তিনি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার বাথানগাছী গ্রামের মো. আলতাফ হোসেন ও সুফিয়া খাতুন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ৩৫তম বিসিএসের এই মোছা. রনী খাতুন এখন শ্যামনগর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন।

মাতৃত্বের দায়িত্বকে ফেলে রেখে আপনি যেভাবে মানুষের জন্য কাজ করছেন সেটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে এই সংগ্রামী নারী বলেন, বাচ্চাদেরকে দেখাশোনা করা যেমন আমার মাতৃত্বের দায়িত্ব তেমনি আমার সরকারি দায়িত্ব ও সমান ভাবে পালন করা একান্ত কর্তব্য। আমার বাসায় তিনটা ছেলে মেয়ে থাকতে পারে কিন্তু আমার উপজেলার ছেলে মেয়ের সংখ্যা হাজার হাজার। আমি চাই তাদের মুখে হাসি ফুটাতে। সুখে দুঃখে আমি তাদের পাশে থাকতে। এমন বোধ থেকে তাদের কাছে থেকে কাজ করে যাচ্ছি রাত দিন। আমার দায়িত্বে থাকা শ্যামনগর উপজেলা খুবই অবহেলিত কিন্তু আমি তাদের কষ্টকে ভাগ করে নিয়ে তাদের সাথে থেকে কাজ করছি। আমার ছেলে মেয়ে দেখার জন্য আমার পরিবার আছে। কিন্তু আমার উপজেলার সুখ দুঃখ তো আমাকে দেখতে হবে। তাই মাতৃত্বের বিষয়টি যেমন দায়িত্ব তেমনি আমার উপজেলাকে দেখে রাখা ও আমার একান্ত কর্তব্য।

সময়টা ১৯-২০ জানুয়ারি। সাতক্ষীরার শ্যামনগরে বিএনপির বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে রীতিমত ইট বৃষ্টি চলছে। এরই মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে জ্যাকেট কিংবা হেলমেট ছাড়াই শ্যামনগরের এই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছাঃ রনী খাতুন জীবন বাজি রেখে দৌড়াতে লাগলেন উভয় পক্ষের মধ্যবর্তী স্থানের উদ্দেশ্যে। সেদিন তার সাহস যেন দুই পক্ষের যে সংঘর্ষের অবসান ঘটায় তা শুধু সাতক্ষীরাবাসীই না সারাদেশের মানুষ দেখেছে। একজন নারী হয়েও কোনো ধরনের নিরাপত্তা সামগ্রী ছাড়াই ‘বাটল ফিল্ডে’ তার অমন উপস্থিতি চমকে দিয়েছে সবাইকে। সাহসিকতাপুর্ন তার এমন ভুমিকার জন্য সাধারণ মানুষসহ দু’পক্ষই রীতিমত তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। উপকূলের আলোই বলা যায় তাকে।

অতি সম্প্রতি শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের সিংহড়তলী এলাকায় বেড়িবাঁধে ভাঙ্গন দেখা দেয়। কিন্তু তিন দিন কেটে গেলেও সেটাকে রোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। সেই ভাঙন রোধ করার জন্য বাল্কহেড এসে পৌছালেও তারা ভরা কটাল এর কারণ দেখিয়ে বালু উত্তোলনে রাজি হচ্ছিল না। একথা শুনে তাৎক্ষণিক ছোটেন রনী খাতুন। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল রিফাত ও থানার ওসিকে সাথে নিয়ে বাল্কহেডের ড্রাইভার ও মালিককে রাজি করে বালু তোলার কাজ শুরু করান। সময় তখন রাত ১২.৪৫ মিনিট। ঘুটঘুটে কালোরাতে (ইউএনও) নিজ দায়িত্ব নিয়ে বালু উঠিয়ে ভাঙ্গন কবলিত বেড়িবাঁধে জিও ব্যাগের মাধ্যমে বালু না দিলে হয়তোবা ১৫ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ প্লাবিত হত। স্বামী-সন্তান ফেলে দিনরাত তিনি পরিশ্রম করে সিংহড়তলীতো হাসি ফুটিয়েছেন হাজারো মানুষের মুখে।

আপনি থাকেন সারাদিন চাকরিতে আপনার বাচ্চাদের কিভাবে সময় দেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি প্রতিদিন সকাল ৯ টায় অফিসে যাই, ফিরতে ফিরতে প্রায়শঃ প্রায় রাত সাড়ে ৮ হয়ে যায়। সারাদিন বাইরে অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার পর রাতে সব কষ্টের অবসান ঘটিয়ে ছেলে মেয়েদের একটু সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। রাতে ঘুমানোর সময় ওদের আদর করি। বড় মেয়ে এবং মেজো ছেলেটা আমার হাতে খাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে। আমি প্রতিদিন রাতে বাসায় গিয়ে তাঁদের মুখে তুলে খাওয়ানোর চেষ্টা করি। তবে সেটা সব সময় হয়ে উঠে না। তারাও কিছুটা বুঝতে শিখছে মায়ের কষ্ট। মায়ের কাজ। আমার কষ্ট বলতে কিছু নেই। আমি সেবক। আমি আমার সকল সন্তানদের সেবা দিয়ে যাবো। তবে আমার জীবনে আমার পরিবার আমার স্বামী, শাশুড়ী , শ্বশুর, বাবা-মা ভাইয়েরা ভীষণভাবে সাহয্য করেছে সামাজিক ও মানসিক ভাবে। আমি আমার মাতৃত্ব এবং আমার সরকারি দায়িত্ব ভীষনভাবে ভালোবাসি। অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে আমার ভালো লাগে। সকলে আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন- এভাবেই বলছিলেন মিসেস রনী খাতুন।

আসলে তিনি নারী হলেও পুরুষের থেকে কোন অংশে কম নন। নারীরাও মানুষ তিনি দেখিয়েছেন দেশের উপকূূলীয় বিপদসংকুল উপজেলা শ্যামনগরে। স্থানীয়রা সংগ্রামী এই নারীকে ভালোবেসে ‘উপকূলের আলো’ উপাধী দিতেও ভুল করেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *