কালিগঞ্জে অস্তিত্ব সংকটে খাল…….. দায় কার?
স্টাফ রিপোর্টার: কালিগঞ্জে অস্তিত্ব সংকটে শতাধিক খাল। দায় নিচ্ছে না কেউ। তবে দায় কার? এমন প্রশ্ন জনমনে। গত ২৫ বছরে অন্তত ৬০টি খাল জোলে পরিনত হয়েছে। কিছু নালা থাকলেও অদুর ভবিষ্যতে তাও থাকবেনা। অস্তিত্বহীন হবে সকল নালা, খাল, জোল।
সরেজমিনে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে কথা বলে বিষয়টি জানা গেছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (কালিগঞ্জ পওর উপ-বিভাগ) এর কর্মকর্তা শুভেন্দু বিশ্বাস বলেছেন কালিগঞ্জে, ৪১ টি স্লইজ গেট আছে তার মধ্যে ৩৩ টি সচল আছে। আংশিক সচল ৫টি, অচল দুটি এবং একটি অস্তিত্বহীন হয়েছে।
সাধারণ জনমনে প্রশ্ন, ৮টি স্লুইজগেট কেন বন্ধ হলো? অর্ধেক চালু ৫টি, কেন পুরাপুরি সচল রাখা গেলনা? অচল হলো ২টি কিন্তু কেন অচল হলো? কাদের কারনে অচল হলো? ১টি স্লুইজ গেট কিভাবে অস্তিত্বহিন হলো। কোন সদোত্তর নেই শুভেন্দু বিশ্বাসের কাছে।
তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ৪১টি স্লইজ গেটের বিপরীতে ৪১টি জীবিত অথবা মৃত খাল ও স্লইজ গেটের সংখ্যা অংকের হিসেব মিললেও আদতে খালের সংখ্যা আরও অনেক বেশী। আদী যমুনা, কালিন্দী, ইছামতি, কাকশিয়ালী, গলঘেষিয়া, হাবড়া নদী থেকে বের হয়ে যাওয়া ছোট বড় খালের সংখ্যা দেড় শতাধিক। ৫ ও ৩ নং পোল্ডারের কোন জায়গা দিয়ে কোন খাল প্রবাহিত হয়েছে তিনি তা নিজে খোঁজ রাখেন না। ঘুরে দেখেননি তার কর্মএলাকা। স্থানীয় মৎস্যচাষী, কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য আমরা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ণ বোর্ড, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অফিস (কালিগঞ্জ পওর উপ-বিভাগ) এর কর্মকর্তা শুভেন্দু বিশ্বাসকে আমরা চিনিনা। আমরা আমাদের সমস্যা নিয়ে অনেকবার তার অফিসে গিয়েছি। কিন্তু দেখা করতে পারিনি। এমন কি তিনি ফোনও ধরেন না। অফিসে আসা তো দুরের কথা। তাহলে কালিগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অফিস (কালিগঞ্জ পওর উপ-বিভাগ) এর কর্মকর্তা হিসেবে তার কাজ কি?
কালিগঞ্জের রতনপুর ইউনিয়নের কুলতলী থেকে কাঁকশিয়ালী নদী হয়ে গলঘেষিয়া নদীর কালিকাপুর পর্যন্ত দুরত্ব ৬১ কিলোমিটার। আবার কালিগঞ্জ সদর থেকে আদি যমুনা নদীর স্লইজ গেট ধরে কাঁকশিয়ালী হয়ে গলঘেষিয়া নদীর বাঁশতলা ব্রীজ পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার। এই ২৭ কিলোমিটার নদীর দক্ষিণ পাশে আছে ছোট বড় ৫০ টি খাল এবং ১০টির অধিক স্লইজ গেট। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে নির্মিত এসব স্লইজ গেট এক রকম অকেজো হয়ে মানুষের মরণ ফাঁদে পরিনত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পানি উন্নয়ণ বোর্ড, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অফিস (কালিগঞ্জ পওর উপ-বিভাগ) এর কর্মকর্তারা ফিরে দেখেননি। পঞ্চান্ন এবং ষাট বছর আগে নির্মিত স্লইজ গেট বর্তমান ওয়াপদা রাস্তার মধ্যে মাত্র ৫ থেকে ৬ ফুট চওড়া। আবার দুই পাশে কোন নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। সেকারনে পথচারীরা প্রায় দুর্ঘটনার স্বিকার হয় স্লইজ গেটে পড়ে অথবা ধাক্কা খেয়ে। অথচ কোন পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ণ বোর্ড, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অফিস (কালিগঞ্জ পওর উপ-বিভাগ) এর কর্মকর্তা শুভেন্দু বিশ্বাস উপজেলার ১২ টি ইউনিয়নের মধ্যে প্রবাহিত দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ্যে বড় খালের মধ্যে বিলগুল্লি খাল, মাচুর খাল, খারহাট খাল, সুইলপুর খাল, সাতবসু খাল, খাঞ্জিয়া খাল, খাঞ্জিয়া শাখা খাল, বসন্তপুর খাল, গোলখালি খাল, আমিয়ান খাল, আমবাড়ি খাল, তাড়ালী খাল, তেতুলিয়া খাল, তেতুলিয়া শাখা খাল, ঘুশুড়ী খাল, বরেয়া খাল, সুন্দরখালী খাল, হাড়দ্দা খাল, পাচবাড়িরা খাল, ডেমরাইল খাল, মৌখালি খাল, বাহাদুরপুর খাল, শিবপুর খাল, কুলতলী খাল, দুরমুজ খালি খাল, নৈকাটি খাল, পরাণপুর খাল, মদিনারদরগা খাল, দূর্বা ডাঙ্গা খাল, উত্তর শ্রীপুর খাল, গোবিন্দকাঠি খাল, কুমারখালি খাল, ইউসুফপুর খাল, মশরকাঠি খাল, সুকুরখালি খাল, কালিকাপুর খালের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সাপখালী খাল, ঝুরঝুরিয়া খাল, পুটিমারি খাল, শুকরো খালী খাল, ঝাউতলী, নিমতলী, সন্নাসীর চক, বালিয়া ডাঙ্গা, জালাল তলার খাল, সন্ধ্যার খাল, ঝপঝুপিয়া, বাগারখালি খাল তিনি তার তালিকা থেকে বাদ রেখেছেন।
স্থানীয়দের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ইতিমধ্যে কিছু খালের শ্রেণী পরিবর্তন করে কালিগঞ্জ উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাদের যোগ সাযোগে কেউ কেউ তাদের নিজেদের নামে রেকর্ড করে জবর দখল করেছেন। শুধু দখল নয় কোন কোন খাল ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করেছেন। এমন দৃষ্টান্ত এই উপজেলায় আছে।
কিন্তু বাংলাদেশ পানি উন্নয়ণ বোর্ড, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অফিস (কালিগঞ্জ পওর উপ-বিভাগ) এর কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হিসিবে (ক) নদী ও নদী অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, সেচ ও খরা প্রতিরোধের লক্ষ্যে জলাধার, ব্যারেজ, বাঁধ রেগুলেটর বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণ। (খ) সেচ, মৎস্য খামার, নৌ-পরিবহন, বনায়ন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পরিবেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে পানি প্রবাহের উন্নয়ন কিংবা পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য জলপথ, খালবিল পূনঃখনন। (গ) ভুমি সংরক্ষণ, ভুমি পরিবৃদ্ধি ও পুনরুদ্ধার এবং নদীর মোহনা নিয়ন্ত্রণ। (ঘ) তীর সংরক্ষণ ও নদী ভাঙ্গন হতে সম্ভ্যাব্য ক্ষেত্রে শহর. বাজার, হাট এবং ঐতিহাসিক ও জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ন স্থানসমুগ সংরক্ষণ করা তার কাজ হলেও দৃশ্যমান কোন কাজের অগ্রগতি চোখে পড়েনি।
এব্যাপারে ঠেকরা গ্রামের মোঃ হারুন অর রশিদের বক্তব্য, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অফিস (কালিগঞ্জ পওর উপ-বিভাগ) এর কর্মকর্তা শুভেন্দু বিশ্বাসের দায়িত্বহীনতার কারনে তুলাকাটি থেকে খেজুরতলা রাস্তার মাঝামাঝি বড়খালের উপর একটি রাস্তা নির্মান করে ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ খালের পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে এলজিইডি। অথচ একটি গুরুত্বপূর্ণ খালের পানি প্রবাহ বন্ধ হলেও তিনি শুভেন্দু বিশ্বাস কোন খবর রাখেনা। দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের শ্রীকলা মৌজার মধ্যেদিয়ে এবং ঠেকরা মৌজার মধ্যে দিয়ে বড়খালে সংযুক্ত হওয়া উপখাল দুটির পানি স্থানীয় প্রভাবশালী পানি প্রবাহ বন্ধ করায় প্রতি বর্ষা মৌসুমে ঘের তলিয়ে যায়। যার ফলে মৎস্য চাষীরা প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষি জমি জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে এলাকার মানুষ খাদ্যশস্য সংকটে পড়ে আবার মৎস্য চাষী ও কৃষকদের ক্ষতির মধ্যে সরকার রাজস্ব হারায়।
তারালী ইউনিয়নের গোলখালী গ্রামের আব্দুস ছাত্তার, দীর্ঘদিন ধরে তিনি জনসেবায় নিয়জিত আছেন। তার দাবী কাঁকশিয়ালী নদী থেকে যত খাল প্রবাহিত হয়েছে সব খাল খনন করা হোক। আমিয়ান খাল, গোলখালীর খাল খনন হলে এলাকার মৎস্য চাষীরা নিরাপদে মাছ উৎপাদন করতে পারবে। কৃষকরা জলাবদ্ধতায় পড়বেনা যার ফলে ভালো ফসল উৎপাদন হবে। পানি প্রবাহ না থাকায় একদিকে লবনাক্ততা অন্যদিকে মিঠাপানির অভাব।
কালিগঞ্জের ঘের ব্যবসায়ী জিন্নাত আলী খান বলেন, খালের পানি প্রবাহ উন্মুক্ত করা হোক, পানি প্রবাহ ঠিক না থাকার কারনে আমরা ঘেরে ঠিকমতো পানি তুলতে পারিনা। পানির গভীরতা অভাবে মাছ মারা যায়। আবার বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় ঘের ডুবে মাছ ভেসে যায়। আমরা প্রতিবছর লোকসান খাই। তার উপর জবর দখল কারীরা খাল দখল করে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভুমিকা থাকার কথা ছিল কিন্তু আমরা তাদের কোন তৎপরতা দেখিনি। ফতেপুর গ্রামের শাহাদাৎ হোসেন বলেন গলঘেষিয়া নদী থেকে বের হয়ে বারদাহ ও ইউসুফপুর দিয়ে প্রবাহিত খাল গোবিন্দকাটির কাঁকশিয়ালী নদীতে প্রবাহিত হলে গলঘেষিয়া নদী মরতোনা। এখানে ওয়াবদা নিজে দুটি বড় খালের পানি প্রবাহ নিজে বন্ধ করে দিয়েছে।
কালিগঞ্জের নদ-নদী ও খাল বিল নিয়ে গবেষনা করেন এডভোকেট জাফর উল্যাহ ইব্রাহিম। তিনি বলেন, কালিগঞ্জে শতাধিক খাল ছিলো। এসব খাল ৫টি নদীর সাথে সংযুক্ত। ঘের ব্যবস্থা আসার আগে ছোট বড় খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন ভাল হতো। ফসলী জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতো না। কিন্ত স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঠিক তদারকি না থাকায় এসব খালের অস্তিত্ববিলীন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় নিয়মবহির্ভূত ও শ্রেণী পরিবর্তন করে অধিকাংশ খাল লীজ বা দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। কালিগঞ্জের জলাবদ্ধতা দুর করতে হলে অবিলম্বে এসব খালের বন্দোবস্ত বাতিল করে জনসাধারণের জন্য উম্মুক্ত করতে হবে। সাথে সাথে খাল খননের মাধ্যমে পানি প্রবাহ তরান্বিত করতে হবে।
বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, স্থানীয় প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কারনেই মুলত কালিগঞ্জের অধিকাংশ খাল আজ মৃত। বিশ পঁচিশ বছর আগে পানি নিষ্কাশনের একমাত্র উপায় ছিলো খাল। বিগত ২০ বছরে প্রভাশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের কারনে অধিকাংশ খাল এখন হুমকির মুখে। এলাকায় বর্ষাকালে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয়, হাজার হাজার মানুষ পানিবন্ধি থাকে, জমির ফসল নষ্ট হয়। উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথ উদ্যোগ নিয়ে খাল খনন করলে কালিগঞ্জ জলাবদ্ধতা মুক্ত হবে। আমি দাবী করছি বর্র্ষা মৌসুমের আগে অতিদ্রুত খাল খনন করে জলাবদ্ধতা নিরসন করা হোক, কৃষক ও মৎস্য চাষীদের ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাক।
কালিগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার ওয়াসীম উদ্দীন বলেন অপরিকল্পিত ঘের ব্যবস্থাপনার কারনে জলাবদ্ধতা তৈরী হয়। যে বিলে ঘের আছে সেখানে ঘের থাকুক। ঘের ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণ হয়ে যেন কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ না করে। তবে বিএডিসির মাধ্যমে খাল খনন করা হলে কালিগঞ্জের জলাবদ্ধতা তৈরী হবেনা। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা কালিগঞ্জে ফসল উৎপাদনে যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সে ব্যপারে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
কালিগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তৌকির আহম্মেদ বলেন জলাবদ্ধতা কালিগঞ্জের মৎস্য চাষীদের জন্য ক্ষতির। আমরা সেটা সবাই জানি। এই মুহুর্তে বক্তব্যর চাইতে পদক্ষেপ বেশী জরুরী। অন্যথা এবার বর্ষা মৌসুমে আবারও মৎস্য চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একারনে উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় পদক্ষেপ নিয়ে খাল গুলো উন্মুক্ত ও খনন করতে হবে। সেব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুজা মন্ডল বলেন, আমি ইতিমধ্যে দুই একটি স্পট ভিজিট করেছি এবং বাস্তবতায় দেখেছি। আমি আমার সার্ভেয়ার নিয়ে বিশেষ করে ঠেকরা চৌমুহনী থেকে খেজুরতলা রোডের বড়খাল এলাকায় মাপ দিয়ে দেখবো কতটা খালের জায়গা এবং কতটা খাল দখল হয়েছে। পাশাপাশি উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারকে সাথে নিয়ে এখানে দ্রুত একটি কালভার্টের ব্যবস্থা করবো। পানি যাতে অবাধে কাঁকশিয়ালী নদীতে নামতে পারে সেব্যাপারে পদক্ষেপ নেব।