অনলাইনঅপরাধআন্তর্জাতিককলারোয়াকালিগঞ্জতালাদেবহাটাশ্যামনগরসদরসাতক্ষীরা জেলা

সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে প্রকাশ্যে ৩০ চক্রের মাদক বিক্রি ও সেবন

স্টাফ রিপোর্টার: সাতক্ষীরার সীমান্ত জুড়ে যেন মাদক চোরাকারবারীদের মহোৎসব চলছে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় গড়ে ওঠা একাধিক সংঘবদ্ধ শক্তিশালী মাদক চোরাচালান চক্র। তারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবি’র কিছু অসাধু সদস্যদের অনৈতিক সহায়তায় এই মাদকে কারবার চালিয়ে আসছে বলে জানাগেছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামিলীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশ ও ভারত দু’দেশই তাদের সীমান্তে রেডএলার্ট জারি করে। বিজিবি- বিএসএফ এর কড়া নজরদারি স্বত্ত্বেও প্রতিদিন সাতক্ষীরার বিভিন্ন সীমান্তের চোরাপথ দিয়ে ভারত থেকে আসছে শত শত কোটি টাকার মাদক। বিনিময়ে সেই পথ ধরেই ভারতে যাচ্ছে স্বর্ণের চালান।

সবচেয়ে বেশি মাদক আসছে সাতক্ষীরা সদরের ভোমরার হাড়দ্দহা, লক্ষ্মীদাড়ি ২ নং, ঘোষপাড়া ও ঘোনা গাজীপুর সীমান্তের চোরাপথ দিয়ে। এসব এলাকা দিয়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই শুরু হয় মাদক পারাপারের তোড়জোড়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সাতক্ষীরা জেলায় সবচেয়ে বেশি মাদকের চোরাকারবার চলছে ভোমরা সীমান্তে। ভোমরার অলিগলিতে হাত বাড়ালেই মেলে সব ধরণের মাদক। রমজান মাসেও প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি ও সেবন করতে দেখা যায় চিহ্নিত স্পষ্ট গুলোতে। শুধুমাত্র ভোমরা সীমান্তেই গড়ে উঠেছে ৩০টির মত সংঘবদ্ধ শক্তিশালী মাদক চোরাচালান চক্র।

দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা গেছে ভোমরা সীমান্তে চিহ্নিত মাদক চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে জেলার শীর্ষ মাদক চোরাকারবারি ভোমরা ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের আরশাদ আলী ওরফে ভদু। ভদু’র ছেলে, দুই মেয়ে ও জামাই এরা সবাই পেশাদার মাদক চোরাকারবারি। তাছাড়া, ভদু একাধিক মাদক মায়লায় অভিযুক্ত হয়ে পুলিশের ভয়ে ৮ বছর ভারতে পালিয়ে থাকার পর গত তিন বছর আগে ফিরে আসে সাতক্ষীরায়। ভদু ও তার ছেলে শামিম, মেয়ে লিপি খাতুন, পাপিয়া খাতুন, জামাই হালিম মাস্টার এদের সবারই পৃথক মাদকের ব্যবসা রয়েছে।

এদের মধ্যে হালিম মাস্টার, তার স্ত্রী পাপিয়া খাতুন ভোমরা টাওয়ার মোড়ে বসবাস করলেও পুরো সীমান্ত জুড়ে রয়েছে তাদের বিস্তৃত মাদক কারবারি নেটওয়ার্ক। ভদুর মেয়ে পাপিয়া খাতুন নিজ বাড়িতে বসেই মাদকের পাইকারি ও খুচরা ব্যাবসা করে। হালিম মাস্টার নিজে টাওয়ার মোড়ে বসে দু’জন সহকারী দিয়ে মাদকের রমরমা ব্যবসা পরিচালনা করে।

এছাড়া ভদু’র ছেলে শামিম সীমান্ত এলাকায় ফেনন্সিডিলের ডিলার। ভোমরা এলাকার সবচেয়ে বড় ব্যাবসায়ী শামিম। ভোমরা গয়েশপুর এলাকায় নিজ বিলাসবহুল বাড়িতে বসে কয়েক জন সহযোগী রেখে খুচরা ও পাইকারি ফেনন্সিডিল ও সব ধরনের মাদকের চোরাকারবার করে। শামিম পুলিশ, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু সদস্যসের সাথে সুসম্পর্ক রেখে সাতক্ষীরা জেলাসহ ঢাকা, খুলনা, যশোর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক চোরাচালান করে।

শামিম মামলা হামলা এড়াতে আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে মাদক ব্যবসা চালিয়েছে। তবে এখনও থেমে নেই তার সেই ব্যবসা। অর্থের প্রভাব খাটিয়ে মাদক কারবার চালাচ্ছে দেদারছে। এছাড়া ভদুর জামাই হালিম মাস্টারের নামে ৮টি মাদকের মামলা রয়েছে ও স্ত্রী পাপিয়ার নামেও মামলা রয়েছে। মাদকের রমরমা ব্যবসা করে তারা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। কিনেছে বিঘা বিঘা জমি। গড়েছে টাইলস বাধানো আলিশান বাড়ি।

এদিকে, মাদকের আরেক চোরাকারবার মাহমুদপুর গোয়ালপাড়া এলাকার হাসান সরদারের ছেলে ইসরাফিল সরদার। সে ফেন্সিডিল, অস্ত্র ও স্বর্ণের ব্যবসায় জেলার শীর্ষ চোরাকারবারি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। ইসরাফিলের চালানে আসে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল। বিভিন্ন ব্রান্ডের মদ, গাঁজা, ইয়াবাসহ সকল ধরনের মাদক এবং অস্ত্র ও গুলি। সে এসব চালানের বিপরীতে ভারতীয় কারবারিদের স্বর্ণ দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে।

ভোমরা সীমান্তের অন্যান্য মাদক কারবারিরা হলো মাহমুদপুরের নাটাপাড়া এলাকার গাঁজা ব্যবসায়ী আবু তালেবের ছেলে ফেনসিডিল ব্যবসায়ী তুহিন, মাহমুদপুর গাঙ্গানিয়ার বশির কারিকরের ছেলে আজিজুল ইসলাম পলতা, মাহমুদপুর নাটাপাড়া এলাকার সাইদুল, মাহমুদপুর এলাকার হান্নান, গয়েশপুর এলাকার চিহ্নিত মাদক চোরাকারবারি মৃত ছলে সরদারের ছেলে ফারুক, ভোমরা হাড়হদ্দা এলাকার পল্টি রমজান, শ্রীরামপুর এলাকার হাসান, বকুল এরা সবাই চিহ্নিত ও প্রভাবশালী সঙ্গবদ্ধ মাদক চোরাকারবারি। তারা সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় মাদকের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। জেলার সচেতন মহল মনে করে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ এবং চলমান প্রশাসনিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে ওঠা এসব মাদকচক্রকে এখনই থামাতে না পারলে জেলার যুবসমাজ অবধারিত ধ্বংস হয়ে যাবে।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এসব চোরাকারবার চক্র রাতের অন্ধকারে সদর উপজেলার গাজীপুর সীমান্ত, ভোমরা, হাড়হদ্দা ও ঘোনা সীমান্তের বিভিন্ন চোরাপথ দিয়ে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল, ভয়ংকর এলএসডি, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, ইয়াবা, গাঁজাসহ সব ধরনের মাদক আমদানি করে আসছে বহুদিন ধরে। এদের মধ্যে আজিজুল ইসলাম পলতার নামে রয়েছে একাধিক মাদকের মামলা।
তাছাড়া, বাদামতলা ও গয়েশপুর এলাকায় বেপরোয়া ভাবে মাদকের চোরাকারবার চালিয়ে আসছে পুলিশের সোর্স পরিচয় দানকারী ফারুক। এই ফারুক ইয়াবা ও ফেনসিডিল এর পাইকারি বিক্রেতা। ফারুকের নামে রয়েছে ৮ টি মাদকের মামলা।

দেশে অস্থির পালাবদলের এই’সময়ে অন্তবর্তী সরকারের পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুলো জেলা জুড়ে বৃদ্ধি পাওয়া মাদক চোরাকারবার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। সাথে সাথে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও পতিত আমলের মতো নিজেদের মাদক চোরাকারবারিদের সাথে অবৈধ চুক্তি ও সখ্যতা রেখে নামমাত্র অভিযান করে টিকে রয়েছে। অনেকে জানিয়েছেন বিজিবি, সদর থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের একাধিক সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে তারা এই মাদকের চোরাকারবার চালিয়ে আসছে এসব চক্র। ভোমরার একাধিক ব্যবসায়ী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, দিন দিন সীমান্তে মাদকের আগ্রাসন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই রমজানেও থেমে নেই তাদের মাদক কারবার। মাদকের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের বিরোধিতা করলে মিথ্যা মামলা হামলার শিকার হতে হয়। এ-বিষয়ে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভোমরাসহ জেলার সচেতন মহল।

সমাজের সাধারণ মানুষও জানে তারা চিহ্নিত মাদক চোরাকারবারি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তাদের নাম থাকার পরও তারা বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব রাষ্ট্র বিরোধী সমাজ বিধ্বংসী মাদক চোরাকারবারিদের প্রতিহত করতে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর এখনি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন জেলার সুধী সমাজ।

ভোমরাসহ সাতক্ষীরার সীমান্ত পথগুলো জেলা শহরের সন্নিকটে হওয়ায় ছোট-বড় এই ৩০ টি চক্র চিহ্নিত করে প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগে এখনই নির্মুল করতে না পারলে মাদকের ভয়াবহ ছোবলে ধ্বংস হবে উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীরা।

সাতক্ষীরা ব্যাটালিয়ন (৩৩ বিজিবি)র অধিনায়ক লেঃ কর্নেল আশরাফুল হক জানান বিজিবি সদস্যরা প্রতিদিন মাদকবিরোধী বিশেষ টহল পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় মাদক ও বিভিন্ন ধরনের মালামাল জব্দ করে আসছে।

সীমান্তে মাদক বৃদ্ধির বিষয়ে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জানান, সীমান্তে ৮ কি.মি ব্যাপী কাজ করে বিজিবি। ওখানে পুলিশ যেতে পারে না। আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। মাদক প্রতিরোধে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *