কালিগঞ্জশিক্ষাঙ্গন

কালিগঞ্জে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি: প্রধান শিক্ষক বাবলু বহিষ্কার

তাপস কুমার ঘোষ, কালিগঞ্জ: জন্মদিন পালনের নামে গোপন কক্ষে ডেকে নিয়ে ছাত্রীদের প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানিসহ নানাবিধ নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবকদের আন্দোলনের মুখে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের উজ্জীবনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলুকে অবশেষে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) বেলা ১১ টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সভা কক্ষে অত্র বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আহবানে ম্যানেজিং কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।

উক্ত সভায় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুজা মন্ডলের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষক প্রতিনিধি শেখ মুস্তাহিদুর রহমান , অহিদুল ইসলাম , নাসরিন সুলতানা, অভিভাবক সদস্য ও শ্যামনগর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মহিউদ্দিন আহমেদ, এন, এন ,টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু শাহিন।

এর আগে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষককে গত ২১ নভেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ১০ কার্য দিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে তিনি গত ১ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অত্র বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি অনুজা মন্ডলের নিকট লিখিত জবাব দাখিল করেন। এর পরও অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলুকে চূড়ান্ত বহিষ্কারের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রী ,অভিভাবকরা আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। উক্ত সভায় উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আকরাম হোসেনকে আহ্বায়ক রতনপুর তারকনাথ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম এবং খড়িতলা চকদাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসানুজ্জামান মুকুলকে সদস্য করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলু এর আগেও কালিগঞ্জ পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকাকালীন বহু ছাত্রীকে যৌন হয়রানি এবং এক ছাত্রীকে গর্ভপাত ঘটানোর অভিযোগে বরখাস্ত করা হয় । পরে বিষয়টি মোটা অংকের টাকায় রফা দফা করে সেই বহিষ্কারাদেশ থেকে রেহাই পায়।

পরে শ্যামনগরে হায়বাত পুরে ভাড়া বাসায় এক হিন্দু মহিলার সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়লে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা ,সমালোচনার ঝড় ওঠে ঐ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ।

এছাড়াও বহু প্রবাসীর স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক করে টাকা আত্মসাৎ ও সংসার ভাঙা, অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে বলে এলাকার ছাত্র,ছাত্রী ,অভিভাব, ভুক্তভোগীরা সাংবাদিকদের জানান। এ ছাড়াও তিনি উজ্জীবনী ইনস্টিটিউট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকে নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিয়ে অর্ধ কোটি টাকার নিয়োগ-বাণিজ্য সহ বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে শিক্ষকদের লাঞ্চিত করা সহ গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে অনেক শিক্ষককে বাড়িছাড়া করতে বাধ্য করে । এই সুযোগে অনেক শিক্ষকের বাড়িতে যেয়ে পরিবারের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে । তার এই বিকৃত যৌনাচারের হাত থেকে রেহাই পাইনি তারই স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থী, ছাত্রীরা।

গত ৩০ অক্টোবর নিজের অর্থায়নে প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলু ছাত্রীদের জন্মদিন পালনের নামে বিদ্যালয় ছুটির পরে নিজের অফিসের গোপন কক্ষে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করে। উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবকরা গত ১৭ নভেম্বর আন্দোলনে মাঠে নামে । ওই সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলুকে অপসারণের দাবিতে বিদ্যালয়ের কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখে। খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে সহকারি কমিশনার (ভূমি) অমিত কুমার বিশ্বাস পুলিশ ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে যেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে ব্যর্থ হয়। পরে সেনা ক্যাম্পের সদস্যদের সহায়তা নিয়ে অবরুদ্ধ শিক্ষককে উদ্ধার করে সে যাত্রায় রেহাই পেলেও লাগাতার আন্দোলন অব্যাহত থাকে ।

বিষয়টি নিয়ে গত ১৯ নভেম্বর স্কুলের শিক্ষার্থীরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে অভিযোগ জমা না নেওয়ায় ক্ষিপ্ত ছাত্র-ছাত্রীরা ২০ নভেম্বর সকালে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে হাজির হয়ে অভিযোগ জানায় ।এর প্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ২১ নভেম্বর অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করলেও কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবকদের আন্দোলন অব্যাহত থাকে।

বিষয়টি জানতে পেরে গত রবিবার (৫ জানুয়ারি) বেলা ১২ টার দিকে ছাত্র আন্দোলনের সাতক্ষীরা জেলা ছাত্র সমন্বয়ক কমিটির সভাপতি আরাফাত হোসেন এবং সম্পাদক রনির নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল উজ্জীবনী ইনস্টিটিউট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ঘটনা তদন্তে গেলে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক বৃন্দ অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক ইকবাল আলম বাবলুর বিরুদ্ধে অর্ধ লক্ষ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য, বিদ্যালয়ের তহবিল তসরূপ ,আত্মসাৎ ও তার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরে তাকে বহিস্কারের দাবি জানান । এরপর জেলা সমন্বয়ক দল বিকাল ৩ টার দিকে অত্র বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুজা মণ্ডলের সঙ্গে তার অফিস কক্ষে দেখা করে বহুল আলোচিত অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চান । এরপর বিকাল ৫ টার দিকে জেলা ছাত্র সমন্বয়ক দল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ হাফিজুর রহমানের অফিসে সাক্ষাৎ করেন সেখানেও অভিযুক্ত ঐ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ছাত্র সমন্বয়করা জানতে চান ।

এরপর মঙ্গলবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুজা মণ্ডল অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বহিষ্কারের বিষয়টি জানান। তবে এ বিষয়ে ছাত্র,ছাত্রী এলাকার অভিভাবক বৃন্দ লম্পট প্রধান শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে ওই বিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে সাংবাদিকদের জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *