দেবহাটায় সেনা অভিযানে বিপুল অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার, নিহত ১
স্টাফ রিপোর্টার: সাতক্ষীরার দেবহাটায় ১৩’শ বিঘা মৎস্যঘের দখল-পাল্টা দখলকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত খলিশাখালি জনপদে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমান ধারালো অস্ত্র, হাতবোমা ও বোমা তৈরীর সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে সেনা সদস্যরা। পাশাপাশি আটক করা হয়েছে ৬ জনকে।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) ভোররাতে সাতক্ষীরা সেনা ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল হকের নেতৃত্বে খলিশাখালিতে এ অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান চলাকালে দখল-পাল্টা দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ানো দু’পক্ষের মারপিটে কামরুল ইসলাম (৪২) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তিনি খলিশাখালি গ্রামের মৃত আবু বকর গাজীর ছেলে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে বলে সেনাবাহিনী ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
অভিযানে আটককৃতরা হলেন, শ্যামনগর উপজেলার হাজিপুর গ্রামের নরিম সরদারের ছেলে নুরুজ্জামান, আশাশুনি উপজেলার শ্রীগঞ্জ গ্রামের আবু সাঈদের ছেলে সোহেল, কালিগঞ্জ উপজেলার বাবুরাবাদ গ্রামের রুহুল আমিন গাজীর ছেলে মেহেরাব আলী, কাশিবাটি গ্রামের রুহুল আমিন সরদারের ছেলে হাসিবুল হাসান সবুজ, আকরাম গাজির ছেলে রবিউল আওয়াল ও বদরতলা এলাকার জামিল ফকিরের ছেলে আবুল হোসেন। উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলা বারুদসহ আটক পরবর্তী তাদেরকে দেবহাটা থানায় সোপর্দ করে সেনাবাহিনী।
জানা গেছে, উপজেলার পারুলিয়া মৌজার খলিশাখালি নামীয় ১৩’শ বিঘা (৪৩৯.২০ একর) জমি নিয়ে বিনিময় ও খরিদসূত্রে মালিকানা দাবীদার কাজী গোলাম ওয়ারেশ, ডা. নজরুল ইসলাম, আব্দুল আজিজ গংদের সাথে বিগত কয়েক বছর যাবৎ ভূমিহীন দাবিদার শেখ মকরম হোসেন, আকরাম হোসেন, সাইফুল ইসলাম, গোলাপ ঢালী গংদের বিরোধ চলে আসছিল। বিষয়টি নিয়ে উচ্চ ও নিন্ম আদালতে একে অপরের পক্ষে একাধিক মামলাও রয়েছে। ২০২১ সাল থেকে একের পর এক এ জনপদ দখল-পাল্টা দখলে নিতে হামলা ও বোমাবাজি করে আসছে দু’পক্ষই। বিশেষ করে গত ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এ জনপদে প্রতিপক্ষের হামলা ও বোমাবাজি নিত্যনৈমত্তিক হয়ে উঠেছে। প্রায়শই সেখানে দুপক্ষের সশস্ত্র মহড়া চলতে থাকায় খলিশাখালিসহ আশপাশের এলাকা জুড়ে উত্তেজনা ও আতঙ্ক বিরাজ করছিল।
৫ আগষ্টের পর বিস্তৃর্ণ এ জমির মালিকানা দাবিদার কাজী গোলাম ওয়ারেশ, ডা. নজরুল ইসলাম, আব্দুল আজিজ গংদের পক্ষে সেখানকার পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় নলতা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ও পারুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক বাবুসহ তাদের লোকজনদের হাতে। একাধিকবার ঘটে সশস্ত্র হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা। সম্প্রতি ভূমিহীন দাবিদারদের পক্ষে শেখ মকরম হোসেন, আকরাম হোসেন, সাইফুল ইসলাম, গোলাপ ঢালীসহ তাদের লোকজন ওই সম্পত্তি দখলে নিলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। পাল্টা দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন দুই ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ও গোলাম ফারুক বাবুসহ তাদের সমর্থিত মালিকানা দাবিদার পক্ষের লোকজন।
শুক্রবার ভোররাতে ওই জনপদে অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে যায় সেনাবাহিনীর সাতক্ষীরা ক্যাম্পের সদস্যরা। একইসময়ে ভূমিহীন দাবিদারদের থেকে ওই জনপদের পাল্টা দখল নিতে হামলা চালায় মালিকানা দাবিদার পক্ষের সমর্থিত ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ও গোলাম ফারুক বাবুর লোকজন। ত্রিমুখী সংঘর্ষ, বোমাবাজি ও গোলাগুলিতে মুহুর্তেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। পরে সেখান থেকে ১৫টি হাতবোমা, ৭৫০ গ্রাম বিষ্ফোরক, ৩৫টি শব্দ সৃষ্টিকারী পটকা বাজি, ৫টি রাম দা, হাত বোমা তৈরীতে ব্যবহার্য ৭ প্যাকেট স্প্রিন্টার সহ বোমা তৈরীর সরঞ্জাম উদ্ধার ও ৬জনকে আটক করে সেনাবাহিনীর অভিযানিক দল। একইসাথে দু’পক্ষের সংঘর্ষে আহত কামরুল ইসলামকে মুমুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে সেনাসদস্যরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তবে সেনাবাহিনীর অভিযান চলাকালে মালিকানা দাবিদার পক্ষের সমর্থিত আজিজুর চেয়ারম্যানের লোকজন কামরুল ইসলামকে মৎস্যঘের থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে বলে দাবি নিহতের স্ত্রী মর্জিনা খাতুনের। অপরদিকে নিহত কামরুল ইসলামকে দÐিত অপরাধী ও ডাকাত উল্লেখ করে উত্তেজিত এলাকাবাসির গণপিটুনিতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি সেনাবাহিনী ও পুলিশের। এঘটনায় ওই জনপদ জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বর্তমানে সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে এবং পুলিশি নজরদারি জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেবহাটা থানার ওসি নূর মোহাম্মাদ।
ভূমিহীন দাবিদার পক্ষের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ১৯৫৫ সালে দেবহাটার চÐীচরণ ঘোষ ও তাদের ওয়ারেশদের ফেলে যাওয়া ১ হাজার ৩১৮ বিঘা জমি জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে মালিকানা দাবিসহ গোটা সম্পত্তি ভোগদখল করে আসছিলেন শিমুলিয়ার কাজী আব্দুল মালেকের উত্তরসূরী কাজী গোলাম ওয়ারেশ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইডিয়ালের নির্বাহী পরিচালক ডা. নজরুল ইসলাম, সখীপুরের আব্দুল আজিজসহ শতাধিক ব্যক্তি। বিস্তৃর্ণ এ সম্পত্তি খাস হিসেবে গণ্য করার জন্য ২০১০ সালে দেবহাটার মুক্তিযোদ্ধা জনাব আলী আদালতে মামলা করেন। ২০১২ সালে ওই জমি লাওয়ারিশ জমি হিসেবে আদালত রায় দেয়।
জমির মালিক দাবিদাররা নিন্ম আদালতের রায় এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গেলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০২১ সালে নিন্ম আদালতের রায় বহাল রাখেন। ২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ভূমিহীন দাবিদাররা ওই জমি দখলে নিয়ে তাতে ঝুঁপড়ি ঘর বেঁধে বসবাস করলে এপর্যন্ত একাধিকবার সেখানে দু’পক্ষের অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি ও হামলা-পাল্টা হামলা চলতে থাকে। গত তিন বছরে এ নিয়ে আদালত ও থানায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অন্তত দু’ডজন মামলাও দায়ের করে দু’পক্ষ। ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন খলিশাখালি ভূমিহীন সমিতির সভাপতি আনারুল ইসলাম হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করলে আদালত উভয়পক্ষের বিরুদ্ধে স্থিতাবস্থা জারির নির্দেশ দেন। কিন্তু তৎপরবর্তী সময়ে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনকে ম্যানেজ এবং আদালতের স্থিতাবস্থা জারির নির্দেশকে উপেক্ষা করে খলিশাখালিতে বসবাসরত সেসময়ের কয়েক’শ ভূমিহীন দাবিদার পরিবারের ওপর হামলা ও তাদের ঝুঁপড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে ওই সম্পত্তির দখল নেন মালিকানা দাবিদাররা।
চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি মালিকানা দাবিদার পক্ষের সিভিল রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দিয়ে প্রধান বিচারপতি ওই সম্পত্তি লাওয়ারিশ হিসেবে গণ্য করে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসককে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে খাস করার জন্য পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
অপরদিকে মালিকানা দাবিদার পক্ষে ডা. নজরুল ইসলাম জানান, বিস্তৃর্ণ এ সম্পত্তি সিএস খতিয়ানের মালিক চন্ডিচরণ ঘোষের থেকে ১৯৩৭ সালের পাট্টা/খাট্টা ও কবুলিয়ত দলিলের কোর্টের রায় অনুযায়ী নিলাম খরিদের মাধ্যমে পরবর্তীতে মালিক তেজেন্দ্র নাথ চৌধুরী গংয়ের কাছ থেকে কলিকাতা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে ১৯৫৩ সালের ৪ মার্চ তারিখের ৬৯৪ নং বিনিময় দলিল মূলে মালিক হয়েছিলেন কাজী আব্দুল মালেক গং। পরবর্তীতে ২৯৬২ থেকে ২৯৮০ মোট ১৯ টি খতিয়ানে কাজী আব্দুল মালেক গং সহ প্রজাদের নামে এসএ রেকর্ড প্রকাশিত হয়। কাজী আব্দুল মালেকের মৃত্যুর পর উত্তরসূরী এবং প্রজাদের নিকট থেকে হস্তান্তর সূত্রে বর্তমান মালিকরা উক্ত জমি খন্ডাকারে ক্রয় ও মিউটিশন-খারিজ খতিয়ানের মালিকানা পান। সর্বশেষ সেটেলমেন্ট জরিপে মাঠ পর্চা এবং প্রিন্ট পর্চার মাধ্যমে তাদের নামে গেজেট প্রকাশিত হলে বিগত বাংলা ১৪৩০/১৪৩১ সন পর্যন্ত সরকারি করাদি পরিশোধ করেন।
তিনি আরও বলেন, উক্ত সম্পতি কোনভাবেই এনিমি বা ভেস্টেট প্রোপার্টি কিংবা ‘ক’ বা ‘খ’ তপশীলভ‚ক্ত হয়নি। এসএ রেকর্ড পরবর্তী মোট সম্পত্তির মধ্যে ৮-১০ একর সম্পত্তি এসএ রেকর্ড মালিকগণ সিলিং বর্হিভ‚ত সম্পত্তি হিসেবে সরকারের নিকট সারেন্ডার করেন এবং পিও ৯৮ এর আওতায় সরকার খাস করে স্থানীয় দরিদ্র পরিবারের মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদান করেন। বিএস রেকর্ডে তাদের নাম গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া উক্ত ৪৩৯.২০ একর জমির মধ্যে মাত্র ১২.৫৫ একর সম্পত্তি জমির মালিকদের পানি নিস্কাশনের জন্য খাল শ্রেণি হিসেবে রেকর্ডভ‚ক্ত হয়েছে।