পলিথিন ও প্লাস্টিকের ঝুঁকি: পরিবেশ রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব: এ এইচ এম মাসুম বিল্লাহ
বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা। এটি মানুষের স্বাস্থ্য এবং প্রকৃতির ভারসাম্যকে বিপন্ন করছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এই সমস্যাকে আরো গভীর করছে। তাই পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারের বিষয়ে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। ইতিমধ্যে সকল সরকারী অফিসে ‘সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক’ ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এছাড়া ১লা অক্টোবর থেকে সুপারশপে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্প (যেমন- পাট ও কাপড়ের ব্যাগ) ব্যবহার করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
প্লাস্টিক ও পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো মাটিতে পাঁচশত থেকে হাজার বছর পর্যন্ত অক্ষত থাকতে পারে। প্লাস্টিকের এই দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি মাটির গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত করে। মাটির উর্বরতা কমে যায়। এছাড়া, প্লাস্টিক ও পলিথিন পোড়ালে পরিবেশে বিপজ্জনক গ্যাস নিঃসরণ হয়, যা বায়ুদূষণের কারণ। এ ধরনের গ্যাস মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। অনেক সময় প্রাণীরা প্লাস্টিক ও পলিথিন গিলে বা পেঁচিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির জন্য পলিথিন ও প্লাস্টিক অনেকাংশেই দায়ী। প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যাগ পয়ঃনিষ্কাশন সিস্টেমে আটকে এর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সঠিকভাবে বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতি কৃষিজ ব্যবস্থা ও সামগ্রিক নাগরিক জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করে। এছাড়া, জলাবদ্ধতার কারণে রোগব্যাধির প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ জমে থাকা পানিতে মশার বংশবিস্তার করে। মশা ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়াসহ বিভিন্ন রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে।
প্লাস্টিকের ব্যবহারের মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও রয়েছে। প্লাস্টিকের কেমিক্যাল খাদ্যদ্রব্যে মিশে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, খাবারের প্যাকেজিং বা কন্টেইনারে ব্যবহৃত প্লাস্টিকে কিছু ক্ষতিকর কেমিক্যাল (যেমন বিসফেনল এবং থ্যালেটস) থাকে। এগুলো মানুষের হরমোনাল সমস্যা সৃষ্টি করে। এই ধরনের রাসায়নিক শরীরের এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। আবার, প্লাস্টিকের অতিক্ষুদ্র কণা খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে জমা হয়ে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া, দীর্ঘদিন প্লাস্টিক ব্যবহার করলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার আশংকা বেড়ে যায়। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং প্রজনন সমস্যার জন্য প্লাস্টিকের মাত্রারিক্ত ব্যবহারকে দায়ী করেন অনেক গবেষক। এই কারণে, প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কমানো এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন ৩ হাজার কারখানায় ১ কোটি ৪০ লাখ পিস পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। এই সংখ্যা প্লাস্টিকের বিপুল ব্যবহারকে ইঙ্গিত করে। পরিসংখ্যানে দেখায় যে, পলিথিন এবং অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার অব্যাহতভাবে বাড়ছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্যের মাত্র ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ২ লাখ ২৮ হাজার টন পুনর্ব্যবহার করা হয়। বাকী ৬০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য যথাযথভাবে নিষ্কাশিত না হয়ে মাটিতে, জলাশয়ে বা অন্যান্য স্থানে জমা হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে।
অথচ প্লাস্টিক ও পলিথিনের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করলে নানা ধরনের উপকারিতা পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে কাপড়, পাট, বাঁশ, এবং অন্যান্য জৈব পণ্য। প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করলে পরিবেশের উপর চাপ কমে। কারণ এদের পণ্য তৈরির সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে কম রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করলে, আমরা প্লাস্টিকের উৎপাদন এবং নিষ্কাশনের ফলে সৃষ্ট দূষণ কমাতে পারি। এতে মাটির গুণগত মান রক্ষা পায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।
এছাড়া, এসকল প্রাকৃতিক উপকরণ পচনশীল। এই প্রক্রিয়া পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে বর্জ্যের পরিমাণ যেমন কমে, তেমনি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহার করলে পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ পৃথিবী নিশ্চিত করাও সহজ হয়।
পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে নিত্যব্যবহার্য উপকরণগুলোর মধ্যে কাপড়ের ব্যাগ, ধাতব পানির বোতল, এবং কাঁচের জারের ব্যবহার পরিবেশের ওপর চাপ কমাতে সহায়ক। বাজারে বা দোকানে যাওয়ার সময় কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে গেলে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যাগের প্রয়োজনীয়তা তেমন একটা থাকেনা। কাপড়ের ব্যাগ একাধিকবার ব্যবহার করা যায়।
ধাতব ( বিশেষ করে, স্টিল বা তামার তৈরি) পানির বোতলও একটি চমৎকার পরিবেশবান্ধব বিকল্প। এগুলো দীর্ঘস্থায়ী, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং প্লাস্টিকের বোতলের তুলনায় পরিবেশের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ। ধাতব বোতল ব্যবহার করলে স্বাস্থ্যেরও উপকার হয়। এতে প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক কেমিক্যাল শরীরে প্রবেশ করার কোন সম্ভাবনা নেই। ধাতব বোতলগুলো একসময় ব্যবহারের অযোগ্য হলে সেগুলো অন্য কোন পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। কাঁচের জারও খাদ্য সংরক্ষণের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প। কাঁচের জার নিরাপদ, সহজে পরিষ্কারযোগ্য ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য। এতে খাদ্য সংরক্ষণ করলে তা স্বাস্থ্যকর এবং বিষমুক্ত থাকে।
প্লাস্টিক ও পলিথিন থেকে পরিবেশকে রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধিড় কোন বিকল্প নেই। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হলে গণমাধ্যমে্র সকল প্ল্যাটফরমে এ বিষয়ে লেখালেখি ও প্রচার প্রচারণা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যম সমাজের প্রতিটি স্তরে সহজে তথ্য পৌঁছে দিতে পারে। সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব এবং প্লাস্টিক ও পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে নিয়মিত প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে আরও বেশি সচেতন করতে হবে।
এছাড়া, কর্মশালা এবং সেমিনারের মাধ্যমে মানুষকে পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারের উপকারিতা এবং প্লাস্টিকের বিপদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো যেতে পারে। এসব কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রচারের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি ও সৃজনশীল কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ইতিবাচক মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া, বিভিন্ন সামাজিক ক্লাব বা সংগঠনের মাঝে সমন্বয়ে প্লাস্টিক ও পলিথিনবিরোধী একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গঠন করা যেতে পারে। তারা পরিবেশ সুরক্ষায় সমন্বিতভাবে কাজ করবে।
প্লাস্টিক ও পলিথিন নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো অপরিহার্য। ছাত্রছাত্রীরা সমাজ থেকে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার স্বপ্নে রক্ত ঝরিয়েছে এবং প্রাণ দিয়েছে। তাদের এই সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছে, তারা দেশকে কতটা ভালবাসে। নতুন প্রজন্ম একইভাবে প্লাস্টিক ও পলিথিনের হাত থেকে পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে এগিয়ে আসতে পারে। তরুণ-যুবকরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের মধ্যে সচেতনতা আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে আমরা দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হব।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পরিবেশ সংরক্ষণ, প্লাস্টিকের ঝুঁকি এবং প্রাকৃতিক ও বায়োডিগ্রেডেবল পণ্যের উপকারিতা নিয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা শুধু তথ্য পাবে না, বরং তারা পরিবেশের প্রতি আরও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে প্লাস্টিক ও পলিথিন-বিরোধী প্রজেক্ট করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও প্লাস্টিক-পলিথিন সংগ্রহ অভিযানের কথা বলা যেতে পারে। এই ধরনের প্রকল্প শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলবদ্ধভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেবে। এতে তাদের নেতৃত্বের গুণাবলী ও সামাজিক দায়িত্ববোধ আরও বৃদ্ধি পাবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে সরকার অত্যন্ত আন্তরিকভাবে কাজ করছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সুপারশপগুলোতে ১ অক্টোবর থেকে পলিথিন ও পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ ব্যবহার না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এর পরিবর্তে ক্রেতাদের কেনার জন্য পাট ও কাপড়ের ব্যাগ রাখতে শপিংমলগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
এছাড়া, সকল সরকারী অফিসে প্লাস্টিকের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্প পণ্য ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্লাস্টিকের ফাইল এবং ফোল্ডারের পরিবর্তে কাগজ বা পরিবেশবান্ধব অন্যান্য সামগ্রীর তৈরি ফাইল ও ফোল্ডার ব্যবহার করার জন্য বলা হয়েছে। প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে কাপড় বা পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্লাস্টিকের পানির বোতলের পরিবর্তে কাঁচের বোতল এবং কাঁচের গ্লাস ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।
নির্দেশনায় প্লাস্টিকের ব্যানারের পরিবর্তে কটন ফেব্রিক, জুট ফেব্রিক বা অন্যান্য বায়োডিগ্রেডেবল উপাদানে তৈরি ব্যানার ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। দাওয়াত পত্র, ভিজিটিং কার্ড এবং বিভিন্ন ধরনের প্রচারপত্রে প্লাস্টিকের লেমিনেশন ব্যবহার না করার নির্দেশনা রয়েছে।
বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সরবরাহ করা খাবারের প্যাকেট কাগজের তৈরি বা পরিবেশবান্ধব হতে হবে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস, কাপ, কাটলারিসহ সব ধরনের পণ্য ব্যবহার না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্লাস্টিকের কলমের পরিবর্তে পেনসিল বা কাগজের কলম ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বার্ষিক প্রতিবেদনসহ সব ধরনের প্রকাশনায় লেমিনেটেড মোড়ক এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, ফুলের তোড়ায় প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্লাস্টিক এবং পলিথিনের ব্যবহার বন্ধের এই উদ্যোগ পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতে পরিবেশ নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। আগামীর প্রজন্মের জন্য একটি বসবাসযোগ্য পৃথিবী রাখতে হলে প্লাস্টিক ও পলিথিন নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। আমাদের সকলেরই উচিত এগুলোর পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব বিকল্পগুলো ব্যবহার করা। এই পরিবর্তন বাস্তবায়ন করতে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্লাস্টিক ও পলিথিন থেকে সরে এসে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সবাই উদ্যোগী হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ, নিরাপদ ও সবুজ পৃথিবী নিশ্চিত করতে আমরা সক্ষম হবো।
লেখক: পরিচালক, জনকূটনীতি অনুবিভাগ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়