কালিগঞ্জের কৃষ্ণনগরে দুর্বৃত্তদের রাজত্ব: বাবার পরে টার্গেট মেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান সাফিয়া
স্টাফ রিপোর্টার: কালিগঞ্জের ১নং কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাফিয়া পারভীন। বাবা কেএম মোশাররফ হোসেন ও মা আকলিমা খাতুন লাকিও ছিলেন একই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। ২০১৮ সালে দুর্বৃত্তরা মোশাররফ হোসেনকে হত্যা করলে এলাকাবাসীর ভালোবাসায় তরুণ বয়সেই রাজনীতির মাঠে নামেন সাফিয়া পারভীন। জনসেবার পাশাপাশি দীর্ঘদিন আইনি লড়াই চালিয়ে আসছিলেন বাবার খুনিদের বিরুদ্ধে। মামলার পর খুনিদের প্রায় সবাই ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন।
এর মধ্যে ৫ আগস্ট পরবর্তি আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার শিথিলতার সুযোগে এলাকায় ফিরে আসতে শুরু করে সেইসব খুনিচক্র। সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের চেষ্টা করছে উক্ত খুনিচক্র। তারা এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর ও চাঁদাবাজিসহ নানা নৈরাজ্যমূলক কর্মকাণ্ড করছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ৫ আগস্ট কৃষ্ণনগরের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান সাফিয়া পারভীনের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুট করার পর আগুন জ্বালিয়ে দেয় খুনিচক্র। পরে তার ব্যবহৃত গাড়িটিও পুড়িয়ে দেন চক্রের সদস্যরা। এ ঘটনায় কালীগঞ্জ ও সদর থানায় দুটি মামলা করেছে ভুক্তভোগী পরিবারটি।
তাদের অভিযোগ, অপরাধীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না। এতে করে স্থানীয় এলাকাবাসীও হতাশ। এখন খুনিচক্র টার্গেট করছে সাফিয়াকে। এমনকি কাফনের কাপড় পাঠিয়ে বারবার তাকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বাবার মতো তাকেও হত্যা করে চরম শিক্ষা দিতে চায় খুনিরা। বর্তমানে বাড়িঘর ছেড়ে জীবনরক্ষায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এই ইউপি চেয়ারম্যান।
নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, পুলিশ মহাপরিদর্শক ও সুরক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর আকুতি জানিয়েছেন তিনি।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাতে মোশাররফ হোসেনকে কৃষ্ণনগর বাজারে যুবলীগ কার্যালয়ের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই ইউপিতে উপনির্বাচন হলে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জয়ী হন তার স্ত্রী আকলিমা খাতুন।
এরপর ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর ওই ইউপিতে আবার ভোট হলে মোশাররফ হোসেনের মেয়ে সাফিয়া পারভীন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
তিনি জাতীয় পার্টির (জাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
সাফিয়া পারভীনের স্বজনরা বলেন, ২০১৮ সালে মোশাররফ হোসেনকে হত্যার পর মেয়ে সাফিয়া বাদী হয়ে একই এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জলিল গাইনকে প্রধান আসামি করে ১৯ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ২০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এ মামলার প্রায় সব আসামি গ্রেফতার হলেও পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান।
এছাড়া হত্যা মামলার প্রধান আসামি জলিল গাইনকে পিটিয়ে হত্যা করে ইউনিয়নের বিক্ষুব্ধ জনতা। এ মামলার তদন্ত শেষে ২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ।
এলাকাবাসী জানান, ৫ আগস্ট বর্তমান চেয়ারম্যান সাফিয়া খাতুনের কালিগঞ্জের বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট ও পেট্রোল দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেন তার বাবার হত্যাকারী চক্রের সদস্যরা।
এ ঘটনায় তার বাবার হত্যা মামলার ১৩ আসামিসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১৫ জনের বিরুদ্ধে কালিগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন সাফিয়ার মা আকলিমা খাতুন।
এছাড়া সাফিয়ার গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ৫ সেপ্টেম্বর ২০ জনের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা সদর থানায় একটি মামলা করা হয়। দুটি মামলাই তদন্ত করছে পুলিশ।
কালিগঞ্জ থানা সূত্রে জানা যায়, বাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার মামলায় আসামিরা হলেন সাফিয়ার বাবা মোশাররফ হোসেন হত্যা মামলার আসামি আবদুল জব্বার তরফদারের ছেলে ইয়ার আলী, তার ভাই বাহার আলী ও জহুর আলী, একই গ্রামের বরকতুল্লার ছেলে রেজাউল ইসলাম, আব্দুল খালেকের ছেলে মিজানুর রহমান, কালিকাপুর গ্রামের শওকত সানার ছেলে সাইফুল সানা, একই গ্রামের মনু মোড়লের ছেলে শাহিনুর মোড়ল, আজিজ ফকিরের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, কৃষ্ণনগর গ্রামের শৈলেন্দ্রনাথ মন্ডলের ছেলে রণজিৎ মন্ডল, আবুল হোসেনের ছেলে রেজাউল খাঁ, সালাম মোল্লার ছেলে শাহীনুর মোল্লা, সোলাইমানের ছেলে নূর আহম্মেদ সুরুজ ও সোতা গ্রামের চিত্তরঞ্জন রায়ের ছেলে তপন রায়।
এছাড়া আরও ১০-১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
এ মামলার এজাহারে বলা হয়, ইয়ার আলী, বাহার আলী ও জহুর আলীসহ ১৩ আগস্ট সাফিয়াদের বাড়িতে হামলা তারা পাহারাদার শাহীন ও আসিফকে নগদ টাকা ও সোনার গহনাসহ ১০ লাখ বেশি মালামাল লুট করে নিয়ে যান। পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের ফার্নিচার ও মালামাল নষ্ট করে দেয়।
বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, চেয়ার-টেবিল, খাট, সোফাসহ সব পুড়ে কয়লা হয়ে আছে। ঘরে থাকা পোশাক এক জায়গায় জড়ো করে ধরিয়ে দেওয়া হয়। ধোঁয়ায় বাড়ির কালো হয়ে পলেস্তারা খসে পড়ছে। সাফিয়ার বাবার শেষ স্মৃতি হিসেবে থাকা মোটরসাইকেলটি ও জ্বালিয়ে হয়েছে।
এদিকে দুর্বৃত্তদের ভয়ে চেয়ারম্যানের ব্যবহৃত গাড়িটি সাতক্ষীরা সদর থানাধীন কাশেমপুর গ্রামে রাখা অবস্থায় জ্বালিয়ে দেয়। গাড়ি পোড়ানো মামলার আসামিরা হলেন রেজাউল, তরফদার, কেরামত আলী, রবি উল্লাহ হাফিজুর রহমান, আমিনুর আলী, এরশাদ আলী, রবিউল রহমান, ইসলাম, আলম, মাহাবুব আলম, আফজাল , আবুল হোসেন মধু, আজগর আলী, লিটন গাইন।
কৃষ্ণনগরের বাসিন্দাদের মতে , ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পর উক্ত আসামিরা এলাকায় ফিরে এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে। ডাকাতি বন্ধে এলাকায় পাহারা বসানো হলে তাদের পাঁচজনকে গুলি করে আহত করে এই সন্ত্রাসীরা। তাদের অত্যাচারে সাবেক ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলামসহ এলাকার শতাধিক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
তাছাড়া, চাঁদার দাবিতে স্থানীয় আলিমউদ্দিন গাজীর প্রতিবন্ধী ছেলে রাশেদুলকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় তারা। এ বিষয়ে সাফিয়া পারভীন জানান, তার বাবার হত্যাকারীরা এখন তাকে হত্যার টার্গেট নিয়েছে। কাফনের কাপড় পাঠিয়ে নিয়মিত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। তারা ইউনিয়নে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে চাঁদা নিচ্ছে। যারা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, তাদের বাড়িঘরে হামলা, লুট ও জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তিনি দ্রুত আসামীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
তিনি আরো বলেন, আসামিদের অনেকের বিরুদ্ধে ১৫-২০টি করে মামলা রয়েছে। এসব মামলার অনেকগুলোয় ওয়ারেন্ট আছে। তবে তারা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা, চাঁদাবাজি, বাড়িঘর লুট করলেও কেউ কিছু বলছে না।
এছাড়া তার বাবার হত্যা মামলার সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। কয়েকজনের কাছ থেকে ‘তারা স্বেচ্ছায় সাক্ষী দেয়নি’ এমন বক্তব্য জোরপূর্বক অ্যাফিডেভিড করে লিখিয়ে নিয়েছে।
চেয়ারম্যান আরো বলেন, ওইসব আসামীরা কাফনের কাপড় পাঠিয়ে হুমকি দিয়েছে’ –
তোকে পৃথিবীর কেউ আমাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। তোকে এমনভাবে মারব যে, দেশের মানুষ সারা জীবন মনে রাখবে। কতদিন ঘরে থাকতে পারিস আমরা দেখব। পুলিশ তোকে কতদিন পাহারা দেয় দেখি।’
এদিকে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের নিরাপত্তা ও নিজ এলাকায় ফেরার আকুতি জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি), জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব বরাবর আবেদন করেছেন সাফিয়া পারভীন।
আবেদনে তিনি বলেন, ৫ আগস্ট রাত ৩টার দিকে বাবার হত্যাকারীরা আমার বসতবাড়িতে ঢুকে আমাকে খুন করতে যায়। আমি ও পরিবারের সদস্যরা কোনোরকম পালিয়ে জীবন বাঁচালেও বাড়িঘর লুটপাট করে সবকিছু নিয়ে যায় এবং আগুন জ্বালিয়ে দেয়। দেশের অস্থিতিশীল অবস্থায় তারা এখন এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। যদি আসামিদের গ্রেফতার না করা হয়, তাহলে তারা আমার পরিবারের সবাইকে হত্যা করে ফেলবে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালিগঞ্জ থানার এসআই সুদেব পাল সাংবাদিকদের জানান, বাড়িঘরে হামলা ও পোড়ানোর ঘটনা সত্য। তারা প্রতিদিন অভিযানে গেলেও আসামিদের ধরতে পারছেন না। তবে তাদের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
কালিগঞ্জ থানার ওসি মো.রফিকুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনী’ র সঙ্গে পুলিশ যৌথভাবে অভিযানে গেলেও আসামিদের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে খুব শীঘ্রই তাদের ধরতে পারবেন বলে আশাবাদী তিনি।