শ্যামনগরসাতক্ষীরা জেলা

তিন মাস পর কাল থেকে সুন্দরবনে প্রবেশ করবে বনজীবীরা

স্টাফ রিপোর্টার: দীর্ঘ তিন মাস প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকার পর আগামী রোববার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে উন্মুক্ত হচ্ছে সুন্দরবন। অনুমতি নিয়ে এদিন থেকে পর্যটক ও বনজীবীরা সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন।‌ ইতোমধ্যে সুন্দরবনসংলগ্ন বনজীবী ও ট্যুর অপারেটররা প্রস্তুতি শুরু করেছেন।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) সাধারণ সম্পাদক নাজমুল আজম বলেন, ‘তিন মাস বন্ধ থাকার পর রোববার থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হচ্ছে। টুরিস্টদের জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। বুকিং পেলে রোববার থেকে টুরিস্টদের নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবো।’

এদিকে, সুন্দরবনের প্রবেশের দিন ঘনিয়ে আসায় নৌকা ও জাল মেরামতের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে মাছ ও কাঁকড়া ধরার জন্য ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুন্দরবনে যেতে পারবেন বনজীবীরা।

সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, কৈখালী ও রমজাননগর এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সুন্দরবন সংলগ্ন চুনা, চুনকুড়ি, মালঞ্চ ও খোলপেটুয়া নদীর পাড়ে পুরোনো নৌকা, ছেড়া জাল মেরামত ও রঙ করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন বনজীবীরা। এসব এলাকার প্রায় ১০ হাজার জেলে পরিবার সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে চলায় চারদিকে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। তাদের মুখে বইছে হাসির ঝিলিক।

সুন্দরবন সংলগ্ন মুন্সিগঞ্জ এলাকার বনজীবী ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমাদের গ্রামের প্রায় সকল মানুষ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ নিষেধ থাকার পর রোববার নিষেধাজ্ঞা শেষ হচ্ছে। এরমধ্যে স্থানীয় জেলেরা বন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাশ পারমিট নিয়ে প্রস্তুত হওয়া শুরু করেছে। রোববার ভোররাতেই সবাই সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা হবে’।

নীলডুমুর এলাকার ওয়াহেদ গাজী জানান, নিষেধাজ্ঞা দিলে আমরা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকি। সরকার সুন্দরবনের মাছ ও কাঁকড়া রক্ষায় যে অভিযান চালায় সেটি আরও কঠোর এবং নেট জাল ও কারেন্ট জালের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধসহ অবৈধভাবে সুন্দরবনে চোরা শিকারিদের প্রবেশ বন্ধ করা দরকার। তাহলে সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ কাঁকড়া পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

একই এলাকার আবু হাসান সরদার (৪৫), জামাল হোসেন (৩৫), রফিকুল সরদার (৪০)। তারা নদীতে নামার জন্য জাল ও নৌকা মেরামতের কাজ করছেন। তারা বলেন, প্রতিটি নৌকায় ২-৫ জন জেলে থাকে। পাঁচজনের পাঁচটি পরিবার। আমাদের মাছ পাওয়ার ওপর নির্ভর করে সংসার। মাছ পাওয়া গেলে সংসার ভালো চলে। না পাওয়া গেলে কষ্ট করেই চলতে হয়। অনেকে সন্তানদের নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করেন।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষা, জীবজন্তু ও মাছের প্রজনন বাড়ানোর জন্য ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৯২ দিনের জন্য সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ, কাঁকড়া ধরা ও পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর আগে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে প্রজনন মৌসুম হিসেবে বন্ধ রাখা হয়েছিল কাঁকড়া ধরা। ফলে সুন্দরবনের মাছ ও কাঁকড়া ধরার ওপর নির্ভরশীল মানুষ চরম কষ্টে ছিল।

সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ অফিস সূত্রে জানা যায়, ১ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশন থেকে বিএসসি (নোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) হয়েছে ২ হাজার ৯০০টি।

বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন কর্মকর্তা এবিএম হাবিবুর রহমান জানান, সাধারণত একটি নৌকায় ২-৬ জন করে মাছ কিংবা কাঁকড়া ধরতে সুন্দরবনে ঢুকে থাকেন। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবার মাছ ও কাঁকড়া ধরার অনুমতি দেওয়া হবে। এতে করে আবার কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসবে জেলেদের মাঝে।
তিনি আরো জানান, ‘বনের প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা, বন্যপ্রাণী এবং নদী-খালের মাছের বিচরণ ও প্রজনন কার্যক্রমের সুরক্ষায় প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনে সকল ধরনের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। আগামী রোববার নিষেধাজ্ঞার সময় শেষ হবে। রোববার থেকে বনজীবী ও টুরিস্টরা নিয়ম মেনে অনুমতি সাপেক্ষে সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন। আমরা বনজীবী ও টুরিস্টদের সকল ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছি।’

সুন্দরবন ট্রলার মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হালিম জানান, পর্যটকের ওপর নির্ভর করে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় পাঁচ শতাধিক ট্রলার চলে। সুন্দরবনে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ রাখার পাশাপাশি পর্যটক ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় তাদের প্রায় এক হাজার ট্রলার চালক ও শ্রমিক বেকার জীবনযাপন করেন। তাদের সংসার চলে খুব কষ্টে ধারদেনা করে।

স্থানীয় সাংবাদিক পীযুষ বাউলিয়া পিন্টু বলেন, বছরের প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া ধরা বন্ধ থাকে। মৎস্য বিভাগ প্রতিবছর মাছের প্রজনন মৌসুমে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রাখে। এই অবসরকালে সাগরে মাছ ধরা জেলেদের মাথাপিছু ৮৬ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের জন্য কোনো সুবিধা কিংবা বরাদ্দ নেই। তিনি এ সময় বেকার হয়ে পড়া জেলে ও বাওয়ালিদের জন্য বরাদ্দের দাবি জানান।

পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) এম কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বলেন, তিন মাস পর ১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলে ও বাওয়ালিদের সুন্দরবনে ঢোকার পাস (অনুমতি) দেওয়া হবে। এ জন্য আগে থেকে জেলে বাওয়ালির পাশাপাশি পর্যটক পরিবহনকারী ট্রলার মালিকরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *